স্বপ্ন থেকে বাস্তবতার পথে
বাংলাদেশের যমুনা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ ছিল দীর্ঘদিনের জাতীয় স্বপ্ন। অবশেষে ১৯৯৮ সালের ২৩ জুন উদ্বোধন করা হয় ‘যমুনা বহুমুখী সেতু’—যা এখন ‘যমুনা সেতু’ নামে পরিচিত। এই ৪.৮ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুটি একযোগে সড়ক, রেল, বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং টেলিযোগাযোগের সংযোগ দিয়েছে, ফলে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল সরাসরি রাজধানী ঢাকা ও পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। এটি এশিয়ান হাইওয়ে ও ট্রান্স–এশিয়ান রেলওয়ের অংশ হওয়ায় কৌশলগতভাবেও গুরুত্বপূর্ণ।
প্রকল্পের সূচনা ও পরিকল্পনা
স্বাধীনতার পর থেকেই যমুনার ওপর সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। ১৯৭৩ সালে জাইকা প্রথম সম্ভাব্যতা সমীক্ষা করলেও ১৯৭৬ সালের প্রতিবেদনে ব্যয়-সুবিধা অনুপাত অনুকূলে না থাকায় তা স্থগিত হয়। পরে ১৯৮২–৮৯ সালে নতুন সমীক্ষা ও নকশার মাধ্যমে সেতুটিকে ‘রোড–রেল–পাওয়ার’ বহুমুখী অবকাঠামো হিসেবে চূড়ান্ত করা হয়। ১৯৮৫ সালের ৩ জুলাই গঠিত হয় ‘যমুনা বহুমুখী সেতু কর্তৃপক্ষ’ (JMBA), যা পরে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের আওতায় আসে।
![]()
অর্থায়নের কাঠামো
প্রকল্পে আন্তর্জাতিক তিনটি প্রধান অংশীদার ছিল—বিশ্বব্যাংকের আইডিএ, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপানের ওইসিইএফ (বর্তমান জাইকা–ওডিএ)। প্রতিটি অংশীদার প্রকল্প ব্যয়ের প্রায় ২২% করে বহন করে, আর অবশিষ্ট ৩৪% বহন করে বাংলাদেশ সরকার। প্রতিটি আন্তর্জাতিক অংশীদারের ঋণ ছিল প্রায় ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
দেশীয় অর্থ সংগ্রহে জনগণের অবদান
সরকার দেশীয় তহবিল গঠনে ‘যমুনা সেতু সারচার্জ ও লেভি’ চালু করে। এর আওতায় বিভিন্ন লেনদেন ও সেবায় অতিরিক্ত ফি আরোপ করা হয়। ব্যাংক আমানতের সুদ আয়ের ওপরও ‘ব্রিজ সারচার্জ’ আরোপ করা হয়েছিল, যার মাধ্যমে মোট ৫০৮ কোটি টাকা সংগ্রহ হয়।
নির্মাণ প্রক্রিয়া ও প্রকৌশল নকশা
১৯৯৩ সালে আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে চুক্তি দেওয়া হয়। ১০ এপ্রিল ১৯৯৪ ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন এবং ১৫ অক্টোবর থেকে মূল নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৯৯৮ সালের জুনে কাজ শেষ হয়। মূল সেতু নির্মাণে দায়িত্বে ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার হুন্দাই ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন, আর নদীশাসন কাজে যুক্ত ছিল বেনেলাক্স কনসোর্টিয়াম HAM/VOA। সেতুর নকশায় ব্যবহৃত হয় বক্স–গার্ডার, প্রি–স্ট্রেসড কংক্রিট সেগমেন্ট এবং ‘ব্যালান্সড ক্যান্টিলিভার’ পদ্ধতি। ৫০টি পিয়ারের ওপর বসানো হয় ১২১টি স্টিল টিউবুলার পাইল, যা গভীর স্রোত ও ভূমিকম্প সহনীয় করে তৈরি করা হয়।

সেতুর বহুমুখী সুবিধা
৪.৮ কিমি দীর্ঘ ও ১৮.৫ মিটার প্রশস্ত এই সেতুতে রয়েছে চার লেন সড়ক, ডুয়াল–গেজ রেললাইন, ২৩০ কেভি বিদ্যুৎ সংযোগ, টেলিযোগাযোগ ডাক্ট ও উচ্চচাপ গ্যাস পাইপলাইন—অর্থাৎ এক অবকাঠামোর মধ্যে পাঁচটি জাতীয় নেটওয়ার্কের সংযোগ। উদ্বোধনের সময় এটি বিশ্বে ১১তম দীর্ঘ সেতু ছিল এবং এখনও দক্ষিণ এশিয়ার দীর্ঘতম সেতুগুলোর মধ্যে একটি।
উদ্বোধন
১৯৯৮ সালের ২৩ জুন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুটি উদ্বোধন করেন এবং প্রথম টোল প্রদানকারী যাত্রী হিসেবে সেতুটি অতিক্রম করেন। ওই দিন দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক নতুন যুগের সূচনা হয়।
মোট ব্যয় ও খাতে বরাদ্দ
প্রকল্পের মোট ব্যয় ছিল প্রায় ৯৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে ব্রিজ ও ভায়াডাক্টে ২৮%, নদীশাসনে ৩৫%, সড়ক–এম্বাংকমেন্টে ৭%, পরামর্শক ব্যয়ে ৩%, ভূমি পুনর্বাসন ও পরিবেশে ৭%, স্থাপনায় ১% এবং অন্যান্য খাতে ১৯% ব্যয় হয়।

অর্থনীতি ও সমাজে প্রভাব
সেতু চালুর পর উত্তর–পশ্চিমাঞ্চল থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামগামী যাতায়াতের সময় অর্ধেকে নেমে আসে। কৃষিপণ্য, শিল্পকাঁচামাল ও প্রস্তুতপণ্যের পরিবহন ব্যয় কমে যায়। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কে দেশব্যাপী আন্তঃসংযোগের সুযোগ সৃষ্টি হয়। নদীশাসন–সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা পরবর্তী জাতীয় প্রকল্পগুলোর জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে।
প্রকৌশলগত গুরুত্ব
যমুনার প্রশস্ত ও বন্যাপ্রবণ বেডকে সেতুর নিচে সংকুচিত রাখতে ব্যাপক নদীশাসনের প্রয়োজন হয়েছিল। দীর্ঘ ও গভীর পাইল, ভূমিকম্প-সহনশীল ব্যবস্থা এবং প্রি–কাস্ট সেগমেন্টাল সুপারস্ট্রাকচার ব্যবহারের মাধ্যমে এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে জটিল প্রকৌশল প্রকল্পগুলোর একটি হয়ে ওঠে। আন্তর্জাতিক পর্যায়েও এই প্রকল্প স্বীকৃতি পায়।
জনগণের অংশীদারত্বের উদাহরণ
যমুনা সেতু তহবিলের জন্য সারচার্জ–লেভি চালু ছিল দেশীয় সম্পদ সংগ্রহের একটি অনন্য উদাহরণ। ব্যাংক সুদ আয়ের ওপর সারচার্জ ও অন্যান্য খাতে অতিরিক্ত লেভির মাধ্যমে জনগণ সরাসরি এই বৃহৎ প্রকল্পে আর্থিকভাবে অংশগ্রহণ করেছে। এটি প্রমাণ করেছে, বৃহৎ অবকাঠামো শুধু বৈদেশিক ঋণের ওপর নির্ভরশীল নয়—সুশাসিত দেশীয় নীতিতেও তা বাস্তবায়ন সম্ভব।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















