০৮:২৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

বাংলার লোকসাহিত্যের চোর থেকে আজকের রাষ্ট্র ও সমাজের চোর: শিকড় অনেক দীর্ঘ

বাংলার লোকসাহিত্যে চোর চরিত্র এমন এক প্রতীক, যিনি কখনও প্রতারক, কখনও কৌশলী, আবার কখনও বুদ্ধিদীপ্ত নায়ক। রূপকথা, উপকথা, মঙ্গলকাব্য, পালাগান বা গ্রামীণ গল্প—সবখানেই তার উপস্থিতি লক্ষণীয়। এই চোর কেবল অপরাধী নয়; তিনি গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি, রসিকতা, ব্যঙ্গ ও তির্যকের মূল কেন্দ্র। কিন্তু আজ চোর চরিত্র সীমাবদ্ধ নেই কেবল সাহিত্যে—রাজনীতি, প্রশাসন ও সমাজের ভেতরে তার দৃঢ় অবস্থান তৈরি হয়েছে।

No photo description available.

লোকসাহিত্যে চোরের উপস্থিতি

বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সাহিত্যে চোর চরিত্রের নানা রূপ দেখা যায়।

  • • ঠাকুরমার ঝুলির গল্পে চোর কখনও চতুর,কখনও হাস্যকর।
  • • গোপাল ভাঁড়ের কাহিনিতে চোর সামাজিক ব্যঙ্গের হাতিয়ার,যার মাধ্যমে রাজা বা অভিজাতদের বোকামি উন্মোচিত হয়।
  • • মঙ্গলকাব্য বা লোকগাথায় চোর অনেক সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদী,যিনি ধনী বা শোষকের কাছ থেকে লুট করে গরিবের মধ্যে বিলিয়ে দেন—যেন বাংলার ‘রবিন হুড’।

এসব গল্পে চোর বুদ্ধি, সাহস ও সামাজিক মন্তব্যের প্রতীক হয়ে ওঠেন, শুধুই অপরাধী নন।

চোর চরিত্রের বিবর্তন

সাহিত্যে চোরের রূপ যতটা রোমান্টিক বা ব্যঙ্গাত্মক, বাস্তব জীবনে তা ততটাই কঠিন ও বিপজ্জনক। সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে চোর আর কেবল রাতের আঁধারে লুকিয়ে থাকা নয়—তিনি এখন দিনের আলোয়, ক্ষমতার মঞ্চে বা সংবাদ শিরোনামে প্রতিষ্ঠিত।

১৯ কর্মকর্তার ১৫ জনই দুর্নীতিবাজ

আজকের সরকার ও সমাজে চোর

বর্তমানে “চোর” শুধু বাড়ির চুরি করা অপরাধী নয়। এখন এ শব্দটি দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ক্ষমতাধর কর্মকর্তা, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বা অর্থ আত্মসাৎকারী গোষ্ঠীর প্রতীক।

  • • সরকারি পর্যায়ে:উন্নয়ন প্রকল্পের বাজেট লুট, ঘুষের বিনিময়ে অনুমোদন, তহবিল আত্মসাৎ—সবই আধুনিক চুরির রূপ।
  • • সামাজিক পর্যায়ে:জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম, ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি, এনজিও বা সমবায়ের অর্থ আত্মসাৎ।

চুরির শিকড় কেন গভীর

বাংলার ইতিহাস ও সমাজে চুরির শিকড় বহু পুরোনো।

ঔপনিবেশিক শোষণ: ব্রিটিশ আমলে জমিদারি ব্যবস্থায় রাজস্ব আদায় ও কৃষকের শোষণ মানুষকে বিশ্বাস করিয়েছে—ক্ষমতায় থাকা মানেই লুটপাটে যুক্ত থাকা।

রাজনৈতিক সংস্কৃতি: স্বাধীনতার পর নৈতিকতার ঘাটতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি চুরিকে প্রাতিষ্ঠানিক করেছে।

দুর্নীতিবাজ আর ঘুষখোরদের নাম মুখে নেয়া যেন পাপ | চ্যানেল আই অনলাইন

সামাজিক মানসিকতা: অনেক ক্ষেত্রে চুরি বা দুর্নীতি ধরা না পড়া পর্যন্ত “বুদ্ধিমত্তা” হিসেবে দেখা হয়।

দণ্ডহীনতা: অপরাধী শাস্তি না পেলে মানুষও মনে করে এটি চলমান নিয়ম।

জিনগত ও সাংস্কৃতিক প্রভাব

যদিও জিনোম মূলত জৈবিক, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারও প্রজন্মান্তরে আচরণে প্রভাব ফেলে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রাজনৈতিক ক্ষমতা, প্রশাসনিক সুযোগ ও সামাজিক কাঠামোতে অনিয়ম চলতে থাকলে তা আচরণগত প্রবণতায় রূপ নেয়। ফলে নতুন প্রজন্মও দেখে, চুরি ও দুর্নীতি সফলতার শর্টকাট।

লোকসাহিত্যে চোর ছিল বুদ্ধিদীপ্ত, কখনও মজার, কখনও সামাজিক বার্তাবাহী চরিত্র। কিন্তু আজ বাস্তব সমাজে তার রূপ ভয়ংকর ও গভীরভাবে প্রোথিত। সরকার, রাজনীতি, অর্থনীতি থেকে সামাজিক জীবনের প্রতিটি স্তরে চুরির সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে। এটি দূর করতে হলে কেবল আইন নয়—প্রয়োজন সাংস্কৃতিক পুনর্গঠন, নৈতিক শিক্ষা ও দণ্ডহীনতার অবসান। নইলে আমাদের গল্পের চোর প্রতিদিনের জীবনের প্রধান চরিত্র হয়েই থাকবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

বাংলার লোকসাহিত্যের চোর থেকে আজকের রাষ্ট্র ও সমাজের চোর: শিকড় অনেক দীর্ঘ

০৪:০৫:০৮ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ অগাস্ট ২০২৫

বাংলার লোকসাহিত্যে চোর চরিত্র এমন এক প্রতীক, যিনি কখনও প্রতারক, কখনও কৌশলী, আবার কখনও বুদ্ধিদীপ্ত নায়ক। রূপকথা, উপকথা, মঙ্গলকাব্য, পালাগান বা গ্রামীণ গল্প—সবখানেই তার উপস্থিতি লক্ষণীয়। এই চোর কেবল অপরাধী নয়; তিনি গ্রামীণ সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি, রসিকতা, ব্যঙ্গ ও তির্যকের মূল কেন্দ্র। কিন্তু আজ চোর চরিত্র সীমাবদ্ধ নেই কেবল সাহিত্যে—রাজনীতি, প্রশাসন ও সমাজের ভেতরে তার দৃঢ় অবস্থান তৈরি হয়েছে।

No photo description available.

লোকসাহিত্যে চোরের উপস্থিতি

বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সাহিত্যে চোর চরিত্রের নানা রূপ দেখা যায়।

  • • ঠাকুরমার ঝুলির গল্পে চোর কখনও চতুর,কখনও হাস্যকর।
  • • গোপাল ভাঁড়ের কাহিনিতে চোর সামাজিক ব্যঙ্গের হাতিয়ার,যার মাধ্যমে রাজা বা অভিজাতদের বোকামি উন্মোচিত হয়।
  • • মঙ্গলকাব্য বা লোকগাথায় চোর অনেক সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদী,যিনি ধনী বা শোষকের কাছ থেকে লুট করে গরিবের মধ্যে বিলিয়ে দেন—যেন বাংলার ‘রবিন হুড’।

এসব গল্পে চোর বুদ্ধি, সাহস ও সামাজিক মন্তব্যের প্রতীক হয়ে ওঠেন, শুধুই অপরাধী নন।

চোর চরিত্রের বিবর্তন

সাহিত্যে চোরের রূপ যতটা রোমান্টিক বা ব্যঙ্গাত্মক, বাস্তব জীবনে তা ততটাই কঠিন ও বিপজ্জনক। সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে চোর আর কেবল রাতের আঁধারে লুকিয়ে থাকা নয়—তিনি এখন দিনের আলোয়, ক্ষমতার মঞ্চে বা সংবাদ শিরোনামে প্রতিষ্ঠিত।

১৯ কর্মকর্তার ১৫ জনই দুর্নীতিবাজ

আজকের সরকার ও সমাজে চোর

বর্তমানে “চোর” শুধু বাড়ির চুরি করা অপরাধী নয়। এখন এ শব্দটি দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ক্ষমতাধর কর্মকর্তা, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বা অর্থ আত্মসাৎকারী গোষ্ঠীর প্রতীক।

  • • সরকারি পর্যায়ে:উন্নয়ন প্রকল্পের বাজেট লুট, ঘুষের বিনিময়ে অনুমোদন, তহবিল আত্মসাৎ—সবই আধুনিক চুরির রূপ।
  • • সামাজিক পর্যায়ে:জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম, ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি, এনজিও বা সমবায়ের অর্থ আত্মসাৎ।

চুরির শিকড় কেন গভীর

বাংলার ইতিহাস ও সমাজে চুরির শিকড় বহু পুরোনো।

ঔপনিবেশিক শোষণ: ব্রিটিশ আমলে জমিদারি ব্যবস্থায় রাজস্ব আদায় ও কৃষকের শোষণ মানুষকে বিশ্বাস করিয়েছে—ক্ষমতায় থাকা মানেই লুটপাটে যুক্ত থাকা।

রাজনৈতিক সংস্কৃতি: স্বাধীনতার পর নৈতিকতার ঘাটতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও দায়মুক্তির সংস্কৃতি চুরিকে প্রাতিষ্ঠানিক করেছে।

দুর্নীতিবাজ আর ঘুষখোরদের নাম মুখে নেয়া যেন পাপ | চ্যানেল আই অনলাইন

সামাজিক মানসিকতা: অনেক ক্ষেত্রে চুরি বা দুর্নীতি ধরা না পড়া পর্যন্ত “বুদ্ধিমত্তা” হিসেবে দেখা হয়।

দণ্ডহীনতা: অপরাধী শাস্তি না পেলে মানুষও মনে করে এটি চলমান নিয়ম।

জিনগত ও সাংস্কৃতিক প্রভাব

যদিও জিনোম মূলত জৈবিক, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারও প্রজন্মান্তরে আচরণে প্রভাব ফেলে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রাজনৈতিক ক্ষমতা, প্রশাসনিক সুযোগ ও সামাজিক কাঠামোতে অনিয়ম চলতে থাকলে তা আচরণগত প্রবণতায় রূপ নেয়। ফলে নতুন প্রজন্মও দেখে, চুরি ও দুর্নীতি সফলতার শর্টকাট।

লোকসাহিত্যে চোর ছিল বুদ্ধিদীপ্ত, কখনও মজার, কখনও সামাজিক বার্তাবাহী চরিত্র। কিন্তু আজ বাস্তব সমাজে তার রূপ ভয়ংকর ও গভীরভাবে প্রোথিত। সরকার, রাজনীতি, অর্থনীতি থেকে সামাজিক জীবনের প্রতিটি স্তরে চুরির সংস্কৃতি ছড়িয়ে পড়েছে। এটি দূর করতে হলে কেবল আইন নয়—প্রয়োজন সাংস্কৃতিক পুনর্গঠন, নৈতিক শিক্ষা ও দণ্ডহীনতার অবসান। নইলে আমাদের গল্পের চোর প্রতিদিনের জীবনের প্রধান চরিত্র হয়েই থাকবে।