০৮:২৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫

হাওরের ২ ‘শ ধরনের মাছ কমে ৮০ তে নেমেছে

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর অঞ্চল একসময় দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ জলাভূমি হিসেবে পরিচিত ছিল। বিস্তৃত পানির নিচে লুকিয়ে ছিল শতাধিক প্রজাতির মাছের ভাণ্ডার, যা শুধু স্থানীয় জনগণের খাদ্য চাহিদা পূরণ করত না, বরং দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ী ও জেলেদেরও আকৃষ্ট করত। কিন্তু প্রায় দুই শতকের ব্যবধানে সেই প্রাচুর্যের যুগ শেষ হতে বসেছে। বর্তমানে মাছের প্রজাতি ও সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য পতন ঘটেছে, যা পরিবেশ, অর্থনীতি ও সমাজের জন্য বড় হুমকি।

দুই শতক আগে হাওরের মাছের বৈচিত্র্য
ঐতিহাসিক নথি, প্রবীণ জেলেদের অভিজ্ঞতা এবং স্থানীয় গবেষণার তথ্য থেকে জানা যায়, প্রায় ২০০ বছর আগে হাওরে ১৫০ থেকে ২০০ প্রজাতির মাছ ছিল। আইড়, বোয়াল, চিতল, পাবদা, বাঘাইর, টেংরা, কাতলা, রুই, মৃগেল, শোল, গজার, তেলাপিয়া—এসব স্থানীয় মাছ ছাড়াও মৌসুমি বিদেশি প্রজাতি নদীপথে এসে হাওরে মিলিত হতো। বর্ষায় নদী-খালের মিলনে হাওর হয়ে উঠত জীববৈচিত্র্যের এক স্বর্গরাজ্য। প্রচুর মাছের কারণে স্থানীয়রা সারা বছর প্রোটিনের জন্য মাছের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

বর্তমান অবস্থা: প্রজাতি ও সংখ্যার পতন
বর্তমানে পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যাচ্ছে, হাওরের মাছের প্রজাতি কমে ৮০–৯০ টিতে দাঁড়িয়েছে। চিতল, বাঘাইর ও বোয়ালের মতো মূল্যবান মাছ এখন বিরল। আগে যে মাছগুলো বড় আকারে ধরা পড়ত, এখন সেগুলো ছোট আকারে এবং সীমিত পরিমাণে পাওয়া যায়। মাছের বৈচিত্র্যও কমে গিয়ে রুই, কাতলা, শিং, মাগুর ও কিছু ছোট মাছেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

মাছ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ
প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস: বাঁধ নির্মাণ, কৃষিজমি দখল ও নদী-খালের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রজননস্থল ধ্বংস করছে।
অতিরিক্ত ও অবৈধভাবে মাছ ধরা: ডিমওয়ালা মাছ ধরা, ছোট মাছ নিধন এবং নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার মাছের প্রজনন ব্যাহত করছে।
পানিদূষণ: কৃষিতে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক, শিল্পবর্জ্য ও গৃহস্থালির আবর্জনা পানিকে দূষিত করছে, ফলে মাছের রোগবালাই ও মৃত্যুহার বাড়ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও অনিয়মিত বন্যা: অনিয়মিত বর্ষা ও দীর্ঘ শুষ্ক মৌসুম মাছের জীবনচক্রকে ব্যাহত করছে।

এটি কি ভয়ঙ্কর সংকেত?
হাওরের মাছের এই অবস্থা পরিবেশ ও মানুষের জীবিকার জন্য নিঃসন্দেহে ভয়ঙ্কর সংকেত। মাছ শুধু খাদ্যের উৎস নয়, এটি হাওরের পরিবেশগত ভারসাম্যেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মাছ কমে গেলে জলজ উদ্ভিদ, পাখি, কচ্ছপসহ অন্যান্য প্রাণীর জীবনও হুমকির মুখে পড়ে। একই সঙ্গে হাজার হাজার জেলে পরিবারের জীবিকা সংকটে পড়ে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাকে বাড়িয়ে তোলে।

ভবিষ্যতের জন্য করণীয়

  • প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ রাখা এবং কঠোরভাবে তা বাস্তবায়ন
  • প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ পুনরুদ্ধারে বাঁধ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন
  • পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগ
  • স্থানীয় জনগণকে মাছ রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা

একসময় হাওরের মাছের বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্য ছিল বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও সংস্কৃতির গর্ব। কিন্তু অবহেলা, অতিরিক্ত শোষণ ও পরিবেশের অবনতির কারণে সেই গর্ব এখন হারিয়ে যাচ্ছে। এখনই সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া গেলে হারানো মাছের রাজ্যকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। অন্যথায়, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো শুধু বইয়ের পাতায় পড়বে—“একসময় হাওরে অসংখ্য মাছ ছিল।”

জনপ্রিয় সংবাদ

হাওরের ২ ‘শ ধরনের মাছ কমে ৮০ তে নেমেছে

০৫:০০:২২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১২ অগাস্ট ২০২৫

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের হাওর অঞ্চল একসময় দেশের অন্যতম সমৃদ্ধ জলাভূমি হিসেবে পরিচিত ছিল। বিস্তৃত পানির নিচে লুকিয়ে ছিল শতাধিক প্রজাতির মাছের ভাণ্ডার, যা শুধু স্থানীয় জনগণের খাদ্য চাহিদা পূরণ করত না, বরং দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ী ও জেলেদেরও আকৃষ্ট করত। কিন্তু প্রায় দুই শতকের ব্যবধানে সেই প্রাচুর্যের যুগ শেষ হতে বসেছে। বর্তমানে মাছের প্রজাতি ও সংখ্যায় উল্লেখযোগ্য পতন ঘটেছে, যা পরিবেশ, অর্থনীতি ও সমাজের জন্য বড় হুমকি।

দুই শতক আগে হাওরের মাছের বৈচিত্র্য
ঐতিহাসিক নথি, প্রবীণ জেলেদের অভিজ্ঞতা এবং স্থানীয় গবেষণার তথ্য থেকে জানা যায়, প্রায় ২০০ বছর আগে হাওরে ১৫০ থেকে ২০০ প্রজাতির মাছ ছিল। আইড়, বোয়াল, চিতল, পাবদা, বাঘাইর, টেংরা, কাতলা, রুই, মৃগেল, শোল, গজার, তেলাপিয়া—এসব স্থানীয় মাছ ছাড়াও মৌসুমি বিদেশি প্রজাতি নদীপথে এসে হাওরে মিলিত হতো। বর্ষায় নদী-খালের মিলনে হাওর হয়ে উঠত জীববৈচিত্র্যের এক স্বর্গরাজ্য। প্রচুর মাছের কারণে স্থানীয়রা সারা বছর প্রোটিনের জন্য মাছের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

বর্তমান অবস্থা: প্রজাতি ও সংখ্যার পতন
বর্তমানে পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যাচ্ছে, হাওরের মাছের প্রজাতি কমে ৮০–৯০ টিতে দাঁড়িয়েছে। চিতল, বাঘাইর ও বোয়ালের মতো মূল্যবান মাছ এখন বিরল। আগে যে মাছগুলো বড় আকারে ধরা পড়ত, এখন সেগুলো ছোট আকারে এবং সীমিত পরিমাণে পাওয়া যায়। মাছের বৈচিত্র্যও কমে গিয়ে রুই, কাতলা, শিং, মাগুর ও কিছু ছোট মাছেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

মাছ কমে যাওয়ার প্রধান কারণ
প্রাকৃতিক আবাসস্থল ধ্বংস: বাঁধ নির্মাণ, কৃষিজমি দখল ও নদী-খালের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রজননস্থল ধ্বংস করছে।
অতিরিক্ত ও অবৈধভাবে মাছ ধরা: ডিমওয়ালা মাছ ধরা, ছোট মাছ নিধন এবং নিষিদ্ধ জাল ব্যবহার মাছের প্রজনন ব্যাহত করছে।
পানিদূষণ: কৃষিতে অতিরিক্ত সার ও কীটনাশক, শিল্পবর্জ্য ও গৃহস্থালির আবর্জনা পানিকে দূষিত করছে, ফলে মাছের রোগবালাই ও মৃত্যুহার বাড়ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও অনিয়মিত বন্যা: অনিয়মিত বর্ষা ও দীর্ঘ শুষ্ক মৌসুম মাছের জীবনচক্রকে ব্যাহত করছে।

এটি কি ভয়ঙ্কর সংকেত?
হাওরের মাছের এই অবস্থা পরিবেশ ও মানুষের জীবিকার জন্য নিঃসন্দেহে ভয়ঙ্কর সংকেত। মাছ শুধু খাদ্যের উৎস নয়, এটি হাওরের পরিবেশগত ভারসাম্যেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ। মাছ কমে গেলে জলজ উদ্ভিদ, পাখি, কচ্ছপসহ অন্যান্য প্রাণীর জীবনও হুমকির মুখে পড়ে। একই সঙ্গে হাজার হাজার জেলে পরিবারের জীবিকা সংকটে পড়ে, যা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাকে বাড়িয়ে তোলে।

ভবিষ্যতের জন্য করণীয়

  • প্রজনন মৌসুমে মাছ ধরা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ রাখা এবং কঠোরভাবে তা বাস্তবায়ন
  • প্রাকৃতিক পানিপ্রবাহ পুনরুদ্ধারে বাঁধ ব্যবস্থাপনায় পরিবর্তন
  • পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন প্রয়োগ
  • স্থানীয় জনগণকে মাছ রক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন করা

একসময় হাওরের মাছের বৈচিত্র্য ও প্রাচুর্য ছিল বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা ও সংস্কৃতির গর্ব। কিন্তু অবহেলা, অতিরিক্ত শোষণ ও পরিবেশের অবনতির কারণে সেই গর্ব এখন হারিয়ে যাচ্ছে। এখনই সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া গেলে হারানো মাছের রাজ্যকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। অন্যথায়, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো শুধু বইয়ের পাতায় পড়বে—“একসময় হাওরে অসংখ্য মাছ ছিল।”