নাফ নদীর অবস্থান ও ভৌগোলিক সংযোগ
নাফ নদী বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপকূল এবং মিয়ানমারের রাখাইন অঙ্গরাজ্যের মধ্যে প্রাকৃতিক সীমানা হিসেবে প্রবাহিত। নদীর উৎপত্তি মিয়ানমারের পাহাড়ি এলাকা থেকে, এরপর এটি দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মিশেছে। এর পশ্চিম তীরে বাংলাদেশ এবং পূর্ব তীরে মিয়ানমার, যা আন্তর্জাতিক নদী হিসেবে নাফকে কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করেছে। বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সরাসরি সংযোগের কারণে এটি শত শত বছর ধরে বাণিজ্য, নৌপরিবহন ও জেলেপাড়ার জীবিকার প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
দুই শত বছর আগের নাফ নদীর তীরবর্তী প্রাকৃতিক পরিবেশ
প্রায় ২০০ বছর আগে নাফ নদীর দুই পাড় ছিল ঘন বন ও সবুজ পাহাড়ে আচ্ছাদিত। পশ্চিম তীরে ছিল টেকনাফের পাহাড়ি বনভূমি, যেখানে শাল, গর্জন, সেগুন, চাপালিশসহ নানা ধরনের বৃক্ষরাজি দেখা যেত। পূর্ব তীরে মিয়ানমারের পাহাড়গুলোতেও ছিল প্রাচীন উষ্ণমণ্ডলীয় চিরসবুজ বন। নদীর পাড়ে ছিল ম্যানগ্রোভজাতীয় গাছপালা, যা জোয়ার-ভাটার সঙ্গে মানিয়ে চলত এবং নদীতীরকে ক্ষয় থেকে রক্ষা করত।

বন্যপ্রাণীর সমৃদ্ধি ও পতনের শুরু
তখন নাফ নদীর তীরবর্তী অঞ্চল ছিল বন্যপ্রাণীর জন্য এক স্বর্গরাজ্য। বাঘ, চিতা, বন্য হাতি, হরিণ, শূকর, বানর, নানা প্রজাতির পাখি, জলচর ও উভচর প্রাণী এ অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে বাস করত। নদীর পানি ও আশপাশের জলাভূমিতে ছিল কুমির, ডলফিন, উটশৃগাল এবং নানা ধরনের জলজ প্রাণী। কিন্তু ১৯শ শতকের শেষভাগ থেকে বৃক্ষনিধন, পাহাড়ি বন ধ্বংস এবং মানুষের বসতি বিস্তারের ফলে বন্যপ্রাণীর সংখ্যা দ্রুত হ্রাস পেতে শুরু করে। ২০শ শতকের মাঝামাঝি থেকে হাতি ও বড় শিকারি প্রাণীর সংখ্যা প্রায় বিলুপ্তির পথে চলে যায়, আর ১৯৭০-এর দশক থেকে বাঘ ও চিতাও এ অঞ্চল থেকে হারিয়ে যায়।
নাফ নদীর মাছ ও জীববৈচিত্র্য
নাফ নদী একসময় ছিল সামুদ্রিক ও স্বাদুপানির মিলিত জোয়ার-ভাটার জন্য বিখ্যাত। নদীতে প্রচুর পরিমাণে ইলিশ, লাক্ষা, কোরাল, পোয়া, চিংড়ি, রুপচাঁদা, বাটা–সহ নানা প্রজাতির মাছ ধরা হতো। বিশেষ করে জোয়ারকালে সামুদ্রিক মাছ এবং ভাটার সময় মিঠাপানির মাছ নদীতে প্রবেশ করত। এ ছাড়া নদীর তলদেশে ছিল ঝিনুক, কাঁকড়া, সামুদ্রিক শামুক, যা স্থানীয় জেলেদের জীবিকার একটি বড় অংশ জোগাত। কিন্তু সাম্প্রতিক দশকে নদী দূষণ, অতিরিক্ত মাছ ধরা এবং নৌচলাচলের চাপ বৃদ্ধির কারণে মাছের প্রজাতি ও পরিমাণ দুটোই কমে এসেছে।

চোরাচালান ও অবৈধ পণ্য পরিবহন
বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ থাকায় নাফ নদী বহু বছর ধরে চোরাচালানকারীদের জন্য একটি সহজ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের ভৌগোলিক সীমানা হওয়ায় নজরদারি জটিল, আর রাতের আঁধারে ছোট ট্রলার বা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় সহজেই পণ্য পারাপার সম্ভব হয়। এ নদী দিয়ে অতীতে এবং এখনো বিভিন্ন ধরনের অবৈধ পণ্য আনা-নেওয়া হয়—যেমন স্বর্ণ, মাদক (বিশেষ করে ইয়াবা), অবৈধ অস্ত্র, বিদেশি সিগারেট, মানুষের পাচার, এমনকি বিরল প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও তাদের চামড়া। ১৯৯০-এর দশকের পর থেকে ইয়াবা পাচারের অন্যতম প্রধান রুট হয়ে উঠেছে নাফ নদী, যা বাংলাদেশে বড় ধরনের সামাজিক ও আইনশৃঙ্খলা সংকট তৈরি করেছে।

নাফ নদীর বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে নাফ নদী জলদূষণ, অতিরিক্ত নৌচলাচল, অবৈধ মাছ ধরা ও চোরাচালান কার্যক্রমের কারণে গুরুতর পরিবেশগত ও নিরাপত্তাজনিত সংকটে আছে। নদীর পাড়ের বনভূমি ও পাহাড়ের বড় অংশ কেটে ফেলা হয়েছে, যার ফলে মাটির ক্ষয় ও নদীর তলদেশ ভরাটের হার বেড়েছে। মাছের প্রজাতি দ্রুত কমে যাচ্ছে, আর ডলফিন ও কুমির এখন প্রায় বিলুপ্ত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সীমান্তে টহল জোরদার করলেও নদীর ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের কারণে এখনো অবৈধ কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব হয়নি। নাফ নদীর ঐতিহাসিক, প্রাকৃতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব রক্ষায় বর্তমানে উভয় দেশের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















