প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ধারাবাহিকতা
ইতিহাস বলছে, প্রতিটি বড় প্রযুক্তিগত পরিবর্তন প্রথমে ভয় তৈরি করলেও শেষ পর্যন্ত তা নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। ১৯৯০-এর দশকে উইন্ডোজ ৯৫-এর আগমন যেমন অফিসকাজে বিপ্লব এনেছিল, তেমনি এআই আজ একই ধরনের রূপান্তরের সূচনা করছে। তখন টাইপিস্ট, ফাইল ক্লার্ক, হিসাবরক্ষকের মতো অনেক পেশা হারিয়ে গেলেও নতুন কাজের ক্ষেত্র—ওয়েব ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল মার্কেটিং, উন্নতমানের আর্থিক বিশ্লেষণ—উদ্ভব হয়েছিল। আজ এআইও সেই পথেই হাঁটছে।
সিঙ্গাপুরের বাস্তবতা ও জনসংখ্যাগত চ্যালেঞ্জ
এআই নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে সিঙ্গাপুরের বড় সমস্যা হলো দ্রুত বয়স্ক হয়ে যাওয়া জনসংখ্যা। ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি চারজনের একজনের বয়স হবে ৬৫ বছরের বেশি, যা “সুপার-এজড” সমাজ তৈরি করবে। কর্মক্ষম মানুষের অনুপাতে প্রবীণের সংখ্যা এত বেড়ে যাবে যে শ্রম ঘাটতি পূরণে এআই অপরিহার্য হয়ে উঠবে।

অতীতের শিক্ষা: অভিযোজন ও উন্নয়ন
শিল্প বিপ্লব কৃষিকাজের চাকরি কমিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু তৈরি করেছিল শিল্পাঞ্চল ও উৎপাদনভিত্তিক কাজ। কম্পিউটার বিপ্লব কেরানি পদের অবসান ঘটালেও সফটওয়্যার, সিস্টেম ও ডিজিটাল সেবা খাত তৈরি করেছিল। সিঙ্গাপুর ৯০-এর দশকে উৎপাদন থেকে অর্থনীতি ও প্রযুক্তিনির্ভর খাতে রূপান্তরিত হয়েছিল এবং দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ করেছিল। ফলে দেশটি আজ বৈশ্বিক শ্রমবাজারে দ্বিতীয় স্থানে আছে, উচ্চ আয়ের দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম।
এআই: নতুন দিক, একই মূলনীতি
এআই ডেটা প্রক্রিয়াকরণের বাইরে গিয়ে লেখালেখি, বিশ্লেষণ ও সৃজনশীল কাজ পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয় করছে। যদিও কিছু চাকরি হারাবে, একই সঙ্গে নতুন এআই-সম্পর্কিত পদ সৃষ্টি হবে। যেমন ডিবিএস ব্যাংক ৪ হাজার চুক্তিভিত্তিক পদ নবায়ন না করলেও ১ হাজার নতুন এআই-সংক্রান্ত চাকরি তৈরি করছে, যা ৩৫০টি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ৮০০ এআই মডেলের মাধ্যমে বছরে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি মূল্য সঞ্চার করবে।
জাপানের অভিজ্ঞতা ও সিঙ্গাপুরের সুযোগ

জাপানও বয়স্ক জনসংখ্যার চাপে স্বয়ংক্রিয়তা গ্রহণ করেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, রোবট ব্যবহারে শুধু উৎপাদনশীলতা নয়, চাকরির সংখ্যাও বেড়েছে। নার্সিং হোমে রোবট কর্মীদের চাপ কমিয়ে দিয়েছে এবং সেবা উন্নত করেছে। সিঙ্গাপুরেও এআই একইভাবে শ্রম ঘাটতি পূরণে সহায়ক হতে পারে।
সুশৃঙ্খল রূপান্তরের কৌশল
সিঙ্গাপুর দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি বিস্তৃত করেছে—২০২৩ সালে ৫ লাখ ২০ হাজার মানুষ এতে অংশ নিলেও ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫ লাখ ৫৫ হাজারে। ডিবিএস ব্যাংক হঠাৎ ছাঁটাই না করে ধীরে ধীরে কর্মী পরিবর্তন করছে এবং ১০ হাজার কর্মীকে এআই ও ডেটা দক্ষতায় প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। সরকারের, নিয়োগকর্তার ও শ্রমিক সংগঠনের ত্রিপক্ষীয় সহযোগিতা প্রযুক্তি গ্রহণকে সবার জন্য সুফলময় করছে।
মানব সৃজনশীলতার মূল্য
ভবিষ্যতে এআই দক্ষতার মূল্য বাড়লেও সৃজনশীলতা, সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি ও সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষমতার মতো মানবিক গুণাবলির গুরুত্বও বাড়বে। জলবায়ু পরিবর্তন, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর যত্ন, মানসিক স্বাস্থ্য বা মহাকাশ অনুসন্ধানের মতো চ্যালেঞ্জ সমাধানে এআই মানুষকে সময় ও সুযোগ দেবে।

উপসংহার: মানুষ ও মেশিনের সহযাত্রা
প্রযুক্তিগত রূপান্তর সবসময় ভয় দিয়ে শুরু হলেও শেষ হয় উন্নতি দিয়ে। সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা দেখায়, পরিবর্তনকে গ্রহণ করে, মানবসম্পদে বিনিয়োগ করে এবং অভিযোজন ক্ষমতায় আস্থা রেখে ভবিষ্যতের দিকে এগোনো যায়। এআই মানুষের কাজ কেড়ে নেবে না, বরং তাদের ক্ষমতা বাড়িয়ে দেবে—যেমন অতীতে হয়েছিল উইন্ডোজ বিপ্লবের পর, তেমনি এবারও হবে।
বেন চেস্টার চিয়ং
আইনবিদ, সিঙ্গাপুর ইউনিভার্সিটি অব সোশ্যাল সায়েন্সেস, ইউনিভার্সিটি অব রিডিং ও এনইউএস এশিয়া-প্যাসিফিক সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল ল’–এর সহযোগী। এছাড়া তিনি আরএইচটিল’ এশিয়ার আইনজীবী।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















