সারাদেশে শিল্প-কারখানা বন্ধের ধাক্কা
গত এক বছরে সাভার, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীতে মোট ৩৫৩টি শিল্প-কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে এক লাখ ১৯ হাজার ৮৪২ শ্রমিক ও কর্মচারী বেকার হয়েছেন। অনেকেই চাকরির সন্ধানে ব্যর্থ হয়ে গ্রামে ফিরে গেছেন। বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার বেশির ভাগই তৈরি পোশাক, নিটওয়্যার ও টেক্সটাইল শিল্পের।
শিল্প মালিকদের দাবি, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার, কাঁচামাল আমদানিতে এলসি জটিলতা, গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট, ক্রমাগত গ্যাসের দাম বৃদ্ধি, শ্রমিক অসন্তোষ এবং ধারাবাহিক মজুরি বৃদ্ধির কারণে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। ফলে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।
সাভারে সর্বাধিক কারখানা বন্ধ
শিল্পাঞ্চল সাভার-আশুলিয়ায় এক বছরে ২১৪টি কারখানা বন্ধ হয়েছে—এর মধ্যে ১২২টি স্থায়ী এবং ৯২টি অস্থায়ীভাবে বন্ধ। এতে প্রায় ৩১ হাজার শ্রমিক ও কর্মচারী বেকার হয়েছেন।

অস্থায়ীভাবে বন্ধ বড় কারখানার মধ্যে আছে ওডিসি ক্রাফট পিডিপি লিমিটেড, মাসকট গ্রুপ, ফ্যাশন নিট গার্মেন্টস (প্রাইড গ্রুপ), গোল্ডস্টার গার্মেন্টস ও সিঙ্গার ইলেকট্রনিকস। স্থায়ীভাবে বন্ধের মধ্যে রয়েছে দ্য ড্রেসেস অ্যান্ড দ্য আইডিয়াস লিমিটেড, জেনারেশন নেক্সট ফ্যাশন, সাফওয়ান আউটার ওয়্যার, চেইন অ্যাপারেলসসহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান।
চেইন অ্যাপারেলস ফেব্রুয়ারিতে বেতন-ভাতা পরিশোধে অক্ষম হয়ে শ্রমিক অসন্তোষের মধ্যে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। এতে এক হাজার ৭৬৫ জন কর্মী বেকার হন। অনেক শ্রমিকের অভিযোগ, ফিঙ্গারপ্রিন্ট লক ব্যবস্থার কারণে অন্যত্র চাকরি পাওয়া যায়নি।
গাজীপুরে ৭২ কারখানা বন্ধ
গাজীপুরে গত এক বছরে ৭২টি কারখানা বন্ধ হয়ে ৭৩ হাজারেরও বেশি শ্রমিক ও কর্মচারী বেকার হয়েছেন। এর মধ্যে মাহমুদ জিন্স, ডার্ড কম্পোজিট, পলিকন, টেক্সটাইল ফ্যাশন, ক্লাসিক ফ্যাশন, লা-মুনি অ্যাপারেলসসহ অনেক কারখানা রয়েছে।
শুধু গত ফেব্রুয়ারিতেই অর্থ সংকটে বেক্সিমকো গ্রুপের ১৩টি পোশাক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে যায়। অধিকাংশ কারখানা বন্ধের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে কাজের অভাব, কার্যাদেশ বাতিল এবং আর্থিক সংকট।

চট্টগ্রামে তৈরি পোশাক ও জাহাজ ভাঙা শিল্পের সংকট
চট্টগ্রামে গত এক বছরে ২১টি কারখানা বন্ধ হয়েছে, এতে অন্তত ১০ হাজার শ্রমিক বেকার হয়েছেন। ২০০৫ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৪১৬টি পোশাক ও শিপ ব্রেকিং কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।
পোশাক খাতে ক্রয়াদেশ কমে যাওয়া, রাজনৈতিক অস্থিরতা, ব্যাংকিং সংকট, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের অনীহা এবং দক্ষ শ্রমিক সংকটের প্রভাব পড়েছে। জাহাজ ভাঙা শিল্পে ১৮০টি ইয়ার্ড থেকে বর্তমানে চালু আছে মাত্র ২৪টি, ফলে বহু শ্রমিক আগেই কর্মহীন হয়েছেন। ডলার সংকট, অতিরিক্ত ভ্যাট, আন্তর্জাতিক বাজারে লোহার মূল্যবৃদ্ধি এবং এলসি জটিলতাও এই খাতকে দুর্বল করেছে।
নারায়ণগঞ্জে ২৬ পোশাক কারখানা বন্ধ
নারায়ণগঞ্জে গত এক বছরে ২৬টি পোশাক কারখানা স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়েছে, এতে ৫ হাজার ৩৪২ শ্রমিক চাকরি হারিয়েছেন। আর্থিক সংকট, কার্যাদেশ কমে যাওয়া এবং দুর্বল ব্যবস্থাপনাকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

কিছু শ্রমিক জীবিকার তাগিদে অটোরিকশা চালাচ্ছেন, কেউ গ্রামে ফিরে গেছেন। শ্রমিক নেতাদের মতে, এই প্রবণতা চলতে থাকলে নারায়ণগঞ্জের শিল্প খাত আরও সংকটে পড়বে।
নরসিংদীতে ২০টি ছোট কারখানা বন্ধ
নরসিংদীতে এক বছরে ২০টি ছোট কারখানা বন্ধ হয়ে প্রায় ৫০০ শ্রমিক ও কর্মচারী বেকার হয়েছেন। হামিদ ফ্যাব্রিকস লিমিটেডসহ কিছু কারখানা গ্যাস সংকট ও বেতন বকেয়া সমস্যায় সাময়িকভাবে বন্ধ আছে, তবে পুনরায় চালু হওয়ার সম্ভাবনা অনিশ্চিত।
সামগ্রিক চিত্র ও ভবিষ্যৎ শঙ্কা
শিল্প খাতের অব্যাহত সংকট, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, ব্যাংক ঋণের কড়াকড়ি এবং জ্বালানি সংকট মিলিয়ে কারখানা বন্ধের ধারা বাড়ছে। মালিক ও শ্রমিক উভয়েরই আশঙ্কা, স্থিতিশীল পরিবেশ না ফিরলে আগামী দিনে আরও অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে। এতে দেশের অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে বড় ধাক্কা লাগবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















