গত তিন মাসে শিল্পযন্ত্র আমদানির জন্য এলসি (ঋণপত্র) খোলার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। এর ফলে শিল্পখাতে নতুন বিনিয়োগ ও উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধির গতি কমে গেছে। কেন শিল্পপতিরা নতুন যন্ত্রপাতি আমদানিতে অনাগ্রহী হচ্ছেন—এটি বোঝা দেশের শিল্পনীতি ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ডলারের সংকট ও আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ এবং ডলারের বাজারে অস্থিরতা আমদানিকে জটিল করে তুলেছে। ব্যাংকগুলো পর্যাপ্ত ডলার সরবরাহ করতে না পারায় এলসি খোলার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হচ্ছে। ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধির ফলে যন্ত্রপাতির দাম বেড়ে গেছে, যা বিনিয়োগের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং উদ্যোক্তাদের নতুন অর্ডার থেকে বিরত রাখছে।

উচ্চ ব্যাংক সুদের হার ও অর্থায়নের সংকট
সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি শিল্পঋণের খরচ বাড়িয়েছে। যন্ত্রপাতি আমদানি সাধারণত দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ, যেখানে বড় অঙ্কের অর্থ একসাথে ব্যয় হয়। সুদের হার বেশি হলে শিল্পপতিরা ঝুঁকি নিতে চান না এবং নতুন প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ না করে অপেক্ষার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহের অনিশ্চয়তা
শিল্প উৎপাদনের জন্য স্থিতিশীল বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবরাহ অপরিহার্য। বর্তমানে এই দুই খাতে ঘাটতি ও ঘন ঘন বিঘ্ন ঘটছে। শিল্পপতিরা মনে করছেন, নতুন যন্ত্রপাতি কিনে উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ালেও বিদ্যুৎ বা গ্যাস সংকট থাকলে পূর্ণ সক্ষমতায় তা চালানো সম্ভব হবে না। ফলে বিনিয়োগে অনীহা দেখা দিচ্ছে।
বাজার অনিশ্চয়তা ও চাহিদা হ্রাস
বিশ্ববাজারে মন্দা, রপ্তানি আদেশ কমে যাওয়া এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে ক্রয়ক্ষমতার হ্রাস শিল্প উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। যখন পণ্যের চাহিদা অনিশ্চিত, তখন শিল্পপতিরা অতিরিক্ত উৎপাদন সক্ষমতার জন্য নতুন যন্ত্রপাতি কিনতে আগ্রহী হন না।

আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও নীতি-অস্থিরতা
যন্ত্রপাতি আমদানিতে শুল্ক, ভ্যাট, এসডি ও অন্যান্য কর প্রক্রিয়ায় জটিলতা রয়েছে। পাশাপাশি নীতি ও কর কাঠামো প্রায়ই পরিবর্তিত হওয়ায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। এই অনিশ্চয়তা বিনিয়োগের আগ্রহ কমিয়ে দিচ্ছে।
পুরনো যন্ত্রপাতি ব্যবহারে বাধ্য হওয়া
নতুন যন্ত্রপাতি আমদানিতে খরচ ও ঝুঁকি বেশি হওয়ায় অনেক শিল্পপতি পুরনো বা ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি মেরামত করে ব্যবহার চালিয়ে যাচ্ছেন। এতে উৎপাদনশীলতা কমছে এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
এলসি খোলার সংখ্যা কমে যাওয়া বর্তমান অর্থনৈতিক সমস্যার প্রতিফলন হলেও এটি ভবিষ্যতের শিল্প সম্প্রসারণ ও রপ্তানি সক্ষমতার জন্যও একটি সতর্ক সংকেত। ডলার সংকট সমাধান, বিদ্যুৎ-গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিতকরণ, সুদের হার স্থিতিশীল রাখা এবং আমদানির প্রশাসনিক প্রক্রিয়া সহজীকরণ ছাড়া এই প্রবণতা বদলানো কঠিন হবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















