বিদেশি বিনিয়োগের সম্ভাবনা
চার মাসের টানা বাণিজ্য আলোচনার পর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন হতে পারে বিদেশ থেকে বিনিয়োগের সম্ভাব্য জোয়ার। জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং দক্ষিণ কোরিয়া উচ্চ শুল্ক এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রে মোট ১.৫ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করেছে—যা ২০২৪ সালে আমেরিকার সামাজিক নিরাপত্তা খাতে সরকারের ব্যয়ের সমান। যদিও এই বিনিয়োগ কবে আসবে বা এর কিছু আগেই ঘটত কি না তা স্পষ্ট নয়, তবু পরিমাণটি চিত্তাকর্ষক। এটি গত ছয় বছরের নতুন বৈশ্বিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের চেয়েও বেশি হতে পারে।
বিদেশি বিনিয়োগের গুরুত্ব
ট্রাম্প প্রশাসনের আগে থেকেই বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বর্তমানে এটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ১০ জন কর্মীর মধ্যে একজনের চাকরি এবং উৎপাদন খাতের ১৬ শতাংশের বেশি চাকরির উৎস। এটি প্রযুক্তি, দক্ষতা ও উদ্ভাবন আনে—যেমন তাইওয়ানের উদ্যোগে অ্যারিজোনায় সেমিকন্ডাক্টর কারখানা—এবং যুক্তরাষ্ট্রের করপোরেট গবেষণা ও উন্নয়নের প্রায় ১৬ শতাংশে অবদান রাখে।

এই বিনিয়োগ দীর্ঘমেয়াদি এবং স্থিতিশীল, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে টেকসই সহায়তা দেয়। বাজেট ঘাটতির কারণে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিনিয়োগ ক্ষমতা সীমিত হওয়ায় বিদেশি অর্থের প্রয়োজন আরও বাড়বে। কিন্তু সমস্যা হলো—বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লে বাণিজ্য ঘাটতিও বাড়বে, যা ট্রাম্পের ঘোষিত লক্ষ্যবিরোধী। তবু অর্থনীতির স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রকে এটি মেনে নেওয়া উচিত।
বাণিজ্য ঘাটতির সাথে সম্পর্ক
বিদেশি বিনিয়োগ আনতে হলে অন্য দেশের ডলার দরকার হয়। বিদেশি মুদ্রা বিক্রি করে ডলার কেনা ডলারের মান বাড়ায়, ফলে আমেরিকান পণ্য বিদেশে বেশি দামে বিক্রি হয় এবং রপ্তানি কমে যায়। এতে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ে। অর্থনীতির মৌলিক নিয়ম হলো—একটি দেশের চলতি হিসাব (পণ্য ও সেবার বাণিজ্য) এবং মূলধন হিসাব (আন্তর্জাতিক মূলধন প্রবাহ) ভারসাম্যপূর্ণ হতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে চাইলে বাণিজ্য ঘাটতি মেনে নিতেই হবে।
নীতিগত অগ্রাধিকার পরিবর্তনের প্রয়োজন

শুধু দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতিকে সাফল্যের মাপকাঠি ধরা সঠিক নয়। বিশাল ভোক্তা বাজার, দক্ষ জনবল, উদ্ভাবনী সংস্কৃতি ও উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর শত শত বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করে। এর সুফল সরাসরি (চাকরি) ও পরোক্ষভাবে (অবসরভাতা তহবিলের আয়) আমেরিকানদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ায়, যা আমদানি ও বাণিজ্য ঘাটতিতে প্রভাব ফেলে।
বিদেশি বিনিয়োগের সাফল্যের উদাহরণ
১৯৯৪ সালে জার্মানির বিএমডব্লিউ দক্ষিণ ক্যারোলিনায় ৬০০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ ও ৫০০ চাকরি দিয়ে যাত্রা শুরু করে। এরপর থেকে তারা সেখানে ১৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে এবং এখন ১১ হাজারেরও বেশি কর্মী নিয়োজিত। শুধু ওই অঙ্গরাজ্যেই বিদেশি মালিকানাধীন ১,১০০টির বেশি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।
নীতিগত কৌশল ও চ্যালেঞ্জ
যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত শিল্পে বিনিয়োগ বাড়াতে চায়, যা জাতীয় নিরাপত্তা ও উৎপাদন কর্মসংস্থানকে শক্তিশালী করবে। বাইডেন প্রশাসন তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানির মতো কৌশলগত প্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারি প্রণোদনা দিয়েছে। ট্রাম্পও কর ছাড়, প্রশাসনিক জটিলতা কমানো এবং অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ দ্রুত অনুমোদনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তবে এর সাথে উচ্চ শুল্কের হুমকি যুক্ত করেছেন।

কানাডা ও যুক্তরাজ্যের সতর্কতা
কানাডা ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে তৃতীয় বৃহত্তম বিনিয়োগকারী ছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ১৪ শতাংশ কানাডীয় সিইও পরিকল্পিত বিনিয়োগ বন্ধ করেছেন এবং ৫৮ শতাংশ বিলম্বিত করেছেন। যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রেও একই প্রবণতা দেখা গেছে—২০২৪ সালের শেষ দিকে যেখানে ৫৯ শতাংশ সিএফও যুক্তরাষ্ট্রকে বিনিয়োগের জন্য আকর্ষণীয় মনে করতেন, ২০২৫ সালের মাঝামাঝি তা নেমে এসেছে মাত্র ২ শতাংশে।
উপসংহার
ট্রাম্প প্রশাসন শিল্প খাতের পুনর্জাগরণ চায়। এটি অর্জনের জন্য শক্তিশালী বিদেশি বিনিয়োগ অপরিহার্য। কিন্তু এর জন্য মিত্র দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং বাণিজ্য ঘাটতি কমানোকে একমাত্র অগ্রাধিকার না করা জরুরি।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















