প্রস্তাবিত নীতির সারসংক্ষেপ
ভারতের আসাম রাজ্য সরকার ‘আদিবাসী’ ও ‘মূল’ বাসিন্দাদের আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র লাইসেন্স দেওয়ার একটি উদার নীতি চালু করতে যাচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মা ৬ আগস্ট ঘোষণা দেন যে, রাজ্যের সংবেদনশীল এলাকায় বসবাসরত ও জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত বাসিন্দারা একটি বিশেষ অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে পারবেন।
সরকারের দাবি, অবৈধভাবে বাংলাদেশ থেকে আসা বাঙালি মুসলিম অভিবাসীদের কারণে স্থানীয়রা হুমকির মুখে পড়ছেন এবং এই নীতি তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। তবে সমালোচকরা বলছেন, এটি আসামের দীর্ঘদিনের জাতিগত ও ধর্মীয় সহিংসতার ইতিহাসকে আরও উসকে দিতে পারে।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও সম্ভাব্য প্রভাব
২০২৬ সালের মার্চ-এপ্রিলের রাজ্য নির্বাচনের আগে এই পদক্ষেপকে অনেকেই রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখছেন। আসামের স্থিতিশীলতা ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যা উত্তর-পূর্ব ভারতের উন্নয়ন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে।

হিন্দু-অধ্যুষিত আসামে বাঙালি মুসলিমরা বারবার ‘অবৈধ অভিবাসী’ হিসেবে কলঙ্কিত হয়েছেন। রাজ্যের প্রায় ২৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ বাংলাদেশ সীমান্তের বড় অংশ নদীবেষ্টিত, যা সীমান্তপাড়াপাড় সহজ করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ থেকে আসামে বিপুল সংখ্যক মানুষ অভিবাসন করেছেন—কেউ জীবিকার খোঁজে, কেউ ধর্মীয় নিপীড়ন এড়াতে।
বাঙালি মুসলিমদের অবস্থান ও উত্তেজনা
সরকারের মতে, অভিবাসনের ফলে জনসংখ্যাগত পরিবর্তন স্থানীয় সংস্কৃতি ও জীবিকায় প্রভাব ফেলছে, যা বহুবার সহিংসতার জন্ম দিয়েছে। আসামের প্রায় ৩৫ মিলিয়ন জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশের বেশি মুসলিম, যা ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ শতাংশ। এর মধ্যে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ বাঙালি মুসলিম, যাদের অনেকে বহু প্রজন্ম ধরে আসামে বসবাস করছেন।
পূর্বে কোকরাঝাড়সহ বিভিন্ন জেলায় বাঙালি মুসলিম ও বোডোদের মধ্যে বড় ধরনের সহিংসতা হয়েছে। যেমন, ২০১৪ সালে বোডো বিদ্রোহীরা ৩০ জনেরও বেশি বাঙালি মুসলিমকে হত্যা করে। এবার যেসব জেলাকে ‘সংবেদনশীল’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে—যেমন ধুবরি, বরপেটা, দক্ষিণ সালমারা-মানকাচার, মরিগাঁও ও নগাঁও—সবগুলোতেই বাঙালি মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ।

সমালোচনা ও বিরোধিতা
সমাজবিজ্ঞানী সুরজ গগৈ একে “অত্যন্ত বিপজ্জনক” ও “ভয় সৃষ্টিকারী” পদক্ষেপ বলে অভিহিত করেছেন। বিরোধী দলগুলোও বলছে, এটি বাঙালি মুসলিম ও অন্যান্য ‘অ-আদিবাসী’ গোষ্ঠীকে নিশানা করার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছে। অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্টের নেতা আশরাফুল হোসেন মনে করেন, এটি ডাকাতি, চুরি ও চাঁদাবাজি বাড়াবে। কংগ্রেস নেতা গৌরব গগৈ মন্তব্য করেছেন, “আসামের মানুষের দরকার চাকরি, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা—বন্দুক নয়।”
এমন নীতি ভারতে নতুন নয়—২০০৫ সালে ছত্তিশগড়ে নকশালবিরোধী অভিযানে ‘সলওয়া জুডুম’ নামে সশস্ত্র গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করা হয়েছিল, যা পরবর্তীতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০১১ সালে আদালতের রায়ে নিষিদ্ধ হয়।

মানবাধিকার উদ্বেগ ও সম্ভাব্য পরিণতি
মানবাধিকারকর্মীরা সতর্ক করে বলছেন, অস্ত্র বিতরণ স্থানীয় পাহারাদার গোষ্ঠীগুলোর হাতে আরও ক্ষমতা দেবে, যা বাঙালি মুসলিমদের চলাচল, বসবাস ও কর্মসংস্থানের স্বাধীনতা সীমিত করতে পারে। নারীনির্ভর সংগঠন ‘নারী নাগরিক মঞ্চ’ সরকারকে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়ে বলেছে, এটি “গৃহযুদ্ধসদৃশ পরিস্থিতি” তৈরি করতে পারে এবং নারী নির্যাতন ও অস্ত্রের প্রসার ঘটাবে।
ড. গগৈ আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, “এটি শুধু গুলি চালানোর জন্য নয়, আরও নানা উপায়ে নিপীড়নের হাতিয়ার হতে পারে। দীর্ঘমেয়াদে আসামের বাঙালি মুসলিমদের জন্য এক অবিরাম স্বাধীনতার সংকোচন তৈরি হবে।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















