বাণিজ্য বিরোধের সূচনা
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভারতের রাশিয়া থেকে তেল কেনাকে কেন্দ্র করে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এর পর তিনি ভারতীয় রপ্তানিপণ্যের ওপর ৫০ শতাংশ শুল্ক বসানোর ঘোষণা দেন, যা চলতি মাসের শেষ দিকে কার্যকর হবে। তবে এই সিদ্ধান্ত শুধু ভূরাজনীতির কারণে নয়; কৃষি ও দুগ্ধশিল্প দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র-ভারত আলোচনায় সবচেয়ে বড় অন্তরায়। এ নিয়েই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পাল্টা জবাব দিয়েছেন। তিনি দিল্লিতে ৭ আগস্ট বলেন, “ভারত কৃষক, দুগ্ধশিল্প ও জেলেদের স্বার্থে কখনো আপস করবে না।”

ভারতের দুধশিল্পের তাৎপর্য
গরু হিন্দু ধর্মে পবিত্র হওয়ায় দুগ্ধশিল্প বিজেপি ও হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। একই সঙ্গে এটি ভারতের জন্য এক জাতীয় গর্বের জায়গা। দারিদ্র্য দূরীকরণ, আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সফল উদাহরণ হিসেবেও এটি দেখা হয়। প্রায় তিন দশক ধরে ভারত বিশ্বের সবচেয়ে বড় দুধ উৎপাদক এবং বর্তমানে বৈশ্বিক মোট উৎপাদনের এক-চতুর্থাংশ ভারতের।
তবে আমেরিকা ও অন্যান্য বাণিজ্যিক অংশীদারদের দৃষ্টিতে ভারতীয় দুধশিল্প অনেক সমস্যার প্রতীক—অকার্যকর উৎপাদন, ভর্তুকি নির্ভরতা, পরিবেশ দূষণ (বিশেষত মিথেন গ্যাস নির্গমন) এবং উচ্চ শুল্ক ও জটিল বিধিনিষেধ। এই দ্বন্দ্বই ভারতের বাণিজ্য কূটনীতিতে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু আমেরিকা নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নও এ নিয়ে আপত্তি জানাচ্ছে। সম্প্রতি ব্রিটেনের সঙ্গে হওয়া মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতেও এটি অন্যতম কঠিন ইস্যু ছিল। ২০১৯ সালে আঞ্চলিক বড় বাণিজ্য চুক্তি থেকে ভারতের সরে দাঁড়ানোর পেছনেও দুগ্ধশিল্প ছিল মূল কারণ।
সাদা বিপ্লব থেকে বর্তমান
ভারতের দুধশিল্প আজও “সাদা বিপ্লবের” আলোয় উজ্জ্বল। ১৯৭০ সালে শুরু হওয়া এ উদ্যোগে ভারত আধুনিক খামার, গবাদিপশুর উন্নত প্রজনন এবং বিশাল কোঅপারেটিভ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে। ইউরোপীয় অর্থনৈতিক সম্প্রদায়ের অনুদান থেকে গুঁড়ো দুধ ও মাখন বিক্রি করে এ ব্যবস্থা আরও শক্তিশালী হয়। এর ফলে মাথাপিছু দুধের প্রাপ্যতা কয়েক দশকে দ্বিগুণ হয়।
যদিও উৎপাদন বেড়েছে, খাতের কাঠামো অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। “সাদা বিপ্লব ২.০” নামে নতুন কর্মসূচি চালু হয়েছে, যার লক্ষ্য সংস্কার নয় বরং সম্প্রসারণ। আগামী পাঁচ বছরে কোঅপারেটিভগুলো দুধ সংগ্রহ ৫০ শতাংশ বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়েছে। উৎপাদন এখনো নির্ভর করছে কোটি কোটি ক্ষুদ্র কৃষকের ওপর—এক-দু’টি গরু, অল্প জমি, সার হিসেবে গোবর, পরিবারের দুধের চাহিদা মেটানোর পর সামান্য উদ্বৃত্ত বাজারে বিক্রি।
ভারত-আমেরিকা তুলনা
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক হিমাংশু বলেন, মোদি ও ট্রাম্প দুজনই কৃষকপন্থী হলেও তাদের কৃষকের বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। ভারতে প্রায় ২০০ মিলিয়ন গবাদিপশু আছে, যার মধ্যে ৬২ মিলিয়ন দুধ উৎপাদনকারী গাভী। গড় খামারে চারটিরও কম গরু থাকে এবং জমির আয়তন মাত্র এক হেক্টর। প্রায় ৮০ মিলিয়ন পরিবার অন্তত একটি গরু বা মহিষ পোষে। বিপরীতে আমেরিকায় ২৪ হাজার ডেয়ারি ফার্ম আছে, প্রতিটিতে গড়ে ৩৯০টি গরু।
ভারতের কোঅপারেটিভগুলো কৃষকদের দুধ বিক্রির নিশ্চয়তা দেয় এবং দাম বাড়লে অতিরিক্ত বোনাসও দেয়। গুজরাটভিত্তিক আমুলসহ কিছু কোঅপারেটিভ এখন আন্তর্জাতিক মানের বড় প্রতিষ্ঠান। এতটাই প্রভাবশালী হয়েছে এই মডেল যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অমিত শাহ সম্প্রতি পর্যটন ও নবায়নযোগ্য শক্তি খাতে একই কাঠামো প্রয়োগের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছেন।
উৎপাদনশীলতা ও সুরক্ষা নীতি
তবুও আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ভারতীয় গরু ও খামার উৎপাদনশীলতায় অনেক পিছিয়ে। একটি আমেরিকান গাভী গড়ে একটি ভারতীয় গাভীর সাতগুণ দুধ দেয়। এজন্য ভারত সরকার দুধ আমদানিতে ৪০-৬০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, যা ট্রাম্পের ভারতীয় রপ্তানির ওপর নতুন শুল্কের সমান কঠোর। অর্গানিক ডেয়ারি ব্যবসা আক্ষয় কালপের প্রধান শশী কুমারের মতে, এসব সুরক্ষা না থাকলে ক্ষুদ্র কৃষকের খামার ভেঙে পড়বে।
শুল্কের বাইরে বাধা
শুধু শুল্কই নয়, ভারত অনেক ক্ষেত্রে আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। তুলা ছাড়া অন্য কোনো জেনেটিক্যালি পরিবর্তিত ফসল ঢুকতে পারে না। দুধের ক্ষেত্রে আছে “নন-ভেজ মিল্ক” নিষিদ্ধকরণ—আমদানি করতে হলে প্রমাণ দিতে হয় যে গাভীদের পশু-উৎপন্ন খাদ্য খাওয়ানো হয়নি। এটি অনেকের কাছে হিন্দুত্ববাদী অজুহাত মনে হলেও আসলে ২০০৩ সালে ইউরোপে “ম্যাড-কাউ” রোগ আতঙ্কের সময় আইন করা হয়েছিল।
কৃষকের শক্তি ও কূটনৈতিক অনিশ্চয়তা
ভারতীয় কৃষকরা একাধিকবার সংস্কার ঠেকিয়ে দিয়েছে। ২০২১ সালে দিল্লিতে টানা আন্দোলনে মোদির সরকারকে তিনটি কৃষি আইন বাতিল করতে বাধ্য করা হয়। এজন্য অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, ট্রাম্প কূটনৈতিক চাপে সংস্কার চাপিয়ে দিতে চাইলে তাতেও সফল হবেন না।
ভারতের দুগ্ধশিল্প এখনো জাতীয় পরিচয়, গ্রামীণ জীবিকার ভরসা ও কূটনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু অকার্যকারিতা ও সুরক্ষা নীতি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এটিকে বড় বাধায় পরিণত করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চলমান এই দ্বন্দ্ব প্রমাণ করছে, ভারতের জন্য কৃষক ও দুধশিল্প শুধু অর্থনীতি নয়, রাজনীতিরও সবচেয়ে স্পর্শকাতর বিষয়।
Sarakhon Report 

























