পরিসংখ্যানের বাইরে এক নতুন চিত্র
ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজের আগে মোহাম্মদ সিরাজকে চেনা যেত একজন ভালো আউটসুইঙ্গার, বিভ্রান্তিকর ‘ওব্ল সিম’ বলের কারিগর এবং সাহসী এক বোলার হিসেবে—কিন্তু পর্যাপ্ত সাফল্য তাঁর ঝুলিতে ছিল না। ইংল্যান্ডে ৩২.৪৩ গড়ে ২৩ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি পাঁচ টেস্টে মোট ১৮৫.৩ ওভার (প্রতি টেস্টে প্রায় ৩৭ ওভার) বল করে তিনি বদলে দিয়েছেন সেই চিত্র। বিশেষ করে যখন জসপ্রিত বুমরাহ তিনটি টেস্ট খেলেছেন, আকাশ দীপ চোটের কারণে অনিয়মিত ছিলেন এবং প্রসিদ্ধ কৃষ্ণা ফর্মহীনতায় ভুগছিলেন, তখন সিরাজের অবদান ছিল অসাধারণ।
ধৈর্য ও ফিটনেসের পেছনের গল্প
প্রখ্যাত স্ট্রেংথ অ্যান্ড কন্ডিশনিং কোচ বাসু শঙ্কর জানালেন, এটি রাতারাতি হয়নি। রয়্যাল চ্যালেঞ্জার্স বেঙ্গালুরু এবং ভারতের জাতীয় দলে সিরাজকে গড়ে তোলার অভিজ্ঞতা তাঁর। “শুরুতে সিরাজ ছিলেন কাঁচা ফাস্ট বোলার। ধীরে ধীরে তিনি ফিটনেস, স্ট্রেংথ ট্রেনিং, ভালো জীবনযাপন, পুষ্টিকর খাদ্য ও সাপ্লিমেন্ট—সবকিছু নিজের জীবনে যুক্ত করেছেন। এটা পাঁচ-ছয় বছরের ফল,” বলেন বাসু।
ফিটনেসে অভ্যস্ত হওয়ার কৃতিত্ব
বাসু বললেন, “যে পটভূমি থেকে সে এসেছে, তাতে ফিটনেস রুটিনকে গ্রহণ করা, ট্রেনিং বোঝা এবং দক্ষতা অক্ষুণ্ণ রাখা—এটা অসাধারণ। বিরাট কোহলি ওর গঠনে বড় ভূমিকা রেখেছেন, আর ওর পরিশ্রমের মানসিকতা দুর্দান্ত।”
নেতৃত্বের চাপেও দৃঢ়তা
জসপ্রিত বুমরাহ-নির্ভর আক্রমণে নিজের জায়গা পাকা করা সহজ ছিল না। কিন্তু ২০২০-২১ অস্ট্রেলিয়া সফরে মাত্র দুই টেস্টের অভিজ্ঞতা নিয়েই নেতৃত্বের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিলেন সিরাজ। সেখানেই এসেছিল তাঁর প্রথম ‘পাঁচ উইকেট’। দীর্ঘ স্পেলে বল করার ক্ষমতা তখনই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল।
টেনিস বল থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে
বাসুর ভাষায়, “সে টেনিস বল দিয়ে দিনে দুই-তিন ম্যাচ খেলত, খারাপ জুতো, বাজে মাঠ—কোনো সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই। ছোটবেলা থেকেই এই খাটুনিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। এরপর রঞ্জি ট্রফি, ভারত ‘এ’ দল—সব জায়গায় অনেক ওভার বল করেছে। আজকের ফিটনেস ও শক্তি সেই ধারাবাহিক পরিশ্রমের ফল।”
দেরিতে শুরু, ধীরে ধীরে শিখন
প্রায় ১৬ বছর বয়সে টেনিস বল ও গলির ক্রিকেটে ফাস্ট বোলিং শুরু করেন সিরাজ, আর ১৯ বছর বয়সে হাতে আসে আসল ক্রিকেট বল। ২০১৮ সালের নিদাহাস ট্রফিতে বাসু তাঁকে প্রথম দেখেন—তখন ট্রেনিং সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। “আমি বলেছিলাম, জটিল কিছু নয়, শুধু অভ্যাস গড়ে তুলো। প্রতিদিন করো, যাতে ট্রেনিংকে বুঝতে পারো। শরীরে প্রভাব দেখা যেতেই ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে যায়,” জানান বাসু। বিরাট কোহলি ও ভারতের বোলিং কোচ ভরতের তত্ত্বাবধানে সিরাজ শেখা চালিয়ে যান।
ফিটনেসের মূল মন্ত্র—ধারাবাহিকতা
বাসুর মতে, সিরাজ খুব বেশি সময় জিমে কাটাতেন না—সপ্তাহে দুই-তিন দিন, এক ঘণ্টার বেশি নয়। কিন্তু নিজের ভিতর থেকেই এসেছে শৃঙ্খলা। কোহলির মতোই জীবনযাপন পরিষ্কার, ভালো খাবার, পর্যাপ্ত বিশ্রাম, আর একই রুটিন বারবার করার ধৈর্য—এগুলোই তাঁর সাফল্যের ভিত্তি।
সরলতায় টিকে থাকা
আজকের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে ফাস্ট বোলারদের জন্য ঝুঁকি থাকলেও, সিরাজের ক্ষেত্রে তা নয়। বাসুর মতে, “সে খুব সহজভাবে সব নেয়। টি২০ আর টেস্ট—এগুলো আলাদা ভাবে ভাবে না। ছোটবেলা থেকেই প্রচুর বল করেছে, তাই ওর ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি কাজ করে, যা সবার ক্ষেত্রে নাও করতে পারে।”