০২:৪০ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২১৫)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:৫৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ অগাস্ট ২০২৫
  • 147

দীনেশচন্দ্র

কিছু গ্রাম্য গান সংগ্রহ করিয়াছিলাম। পরলোকগত যতীন্দ্রমোহন সিংহ মহাশয় সেগুলি পড়িয়া বলিলেন, “তুমি দীনেশবাবুর সঙ্গে দেখা কর। ময়মনসিংহের গ্রাম্য গানগুলি সংগ্রহ করিয়া তিনি অসম্ভব কাণ্ড করছেন। দেশ-বিদেশের মনীষীবৃন্দ সেই গানগুলি পড়ে তারিফ করছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করলে নিশ্চয় তিনি তোমাকে উৎসাহ দিবেন।’

নানা ঘটনা বিপর্যয়ে প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় কলিকাতায় আসিলাম। ভাগ্যক্রমে ডাঃ শহীদুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে আলাপ হইল। তিনি এক মুচির দোকানে জুতা সেলাই করাইতেছিলেন। এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিতে করিতে বলিলেন, “আমি দীনেশবাবুর বাড়ি যাব।” তাহা শুনিয়া আমি তাঁহাকে বলিলাম, “আমিও সেখানে যাব। আপনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন কি?” তিনি আমাকে দীনেশবাবুর বাড়িতে লইয়া গেলেন। যে খাতাখানায় গ্রাম্য গানগুলি সংগ্রহ করিয়াছিলাম দীনেশবাবু সেই খাতাখানার কয়েকটি পাতা উলটাইয়া পালটাইয়া আমার মুখের দিকে চাহিলেন। আবার সেই খাতায় মনোনিবেশ করিলেন। তারপর আবার আমার মুখের দিকে চাহিলেন।

শ্রদ্ধায়-বিস্ময়ে আমার সকল অন্তর কম্পিত হইতেছিল। এই সেই ডাক্তার সেন, যাঁহার ‘বঙ্গ ভাষা ও সাহিত্য’ রাত জাগিয়া জাগিয়া পড়িয়াছি; পদ্মার তীরে কত গভীর রজনীতে যাঁর বই পড়িয়া, দারিদ্র্যের কাহিনী জানিয়া নিজের জীবনকে এক উচ্চতর আদর্শে গড়িয়া লইতে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি। আমার সকল অন্তর সালাম হইয়া যেন তাঁহার সামনে লুটাইয়া পড়িতে চাহিতেছিল। আমি যেন এক গ্রহ হইতে আর এক নূতন গ্রহচক্রের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছি। এ জগতের সকলেই যেন অপার রহস্যে ভরা।

কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার শহীদুল্লাহ্ সাহেবের হাতে একখানা কাগজ দিয়া দীনেশবাবু বলিলেন, “আমি যাহা বলি লিখে যাও। লেখ,- প্রিয় ডাঃ সেন, আপনাকে আমি একজন তরুণ যুবকের সঙ্গে পরিচিত করাইব। ইনি পাড়াগাঁ হইতে মুর্শিদা, বাউল, বারমাসী, মারফতি, জারি, ধুয়া প্রভৃতি নানা প্রকারের গ্রাম্য গান সংগ্রহ করিয়াছেন। আমি জানি, আপনি ছাড়া এমন কোনো ব্যক্তি নাই যাঁহার দ্বারা ইনি উৎসাহিত হইতে পারেন। আপনি যদি তাহাকে কাজে লাগাইতে পারেন বড়ই খুশি হইব।”

ডাক্তার শহীদুল্লাহ সাহেবকে দিয়া এই চিঠি লেখাইয়া তিনি আমাকে বলিলেন, “আমি তো তোমাদের জন্য এখানে বসে সাধনা করছি। মন্ত্র পড়ে তোমাদের কত ডেকেছি। তোমরা এতদিন আস নাই, এখন আমি বৃদ্ধ হয়েছি। আগে আসলে তোমাদের মতো যুবকদের অনেক কিছু করে দিতে পারতাম। তবু দেখা যাক কি করতে পারি। তোমাদের এই প্রশংসাপত্র নিয়ে আজ আমি বাংলার গভর্নর লর্ড লিটন সাহেবকে দেখাব। তুমি যাতে গান সংগ্রহ করে অন্তত মাসে ৭০ টাকা উপার্জন করতে পার সেই ব্যবস্থা করে দিব। কাল সকালে এসে তুমি খবর নিয়ে যেয়ো।”

চলবে…..

জনপ্রিয় সংবাদ

জেন জি এখন সুগন্ধি খুঁজছে

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২১৫)

১১:০০:৫৮ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২১ অগাস্ট ২০২৫

দীনেশচন্দ্র

কিছু গ্রাম্য গান সংগ্রহ করিয়াছিলাম। পরলোকগত যতীন্দ্রমোহন সিংহ মহাশয় সেগুলি পড়িয়া বলিলেন, “তুমি দীনেশবাবুর সঙ্গে দেখা কর। ময়মনসিংহের গ্রাম্য গানগুলি সংগ্রহ করিয়া তিনি অসম্ভব কাণ্ড করছেন। দেশ-বিদেশের মনীষীবৃন্দ সেই গানগুলি পড়ে তারিফ করছেন। তাঁর সঙ্গে দেখা করলে নিশ্চয় তিনি তোমাকে উৎসাহ দিবেন।’

নানা ঘটনা বিপর্যয়ে প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায় কলিকাতায় আসিলাম। ভাগ্যক্রমে ডাঃ শহীদুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে আলাপ হইল। তিনি এক মুচির দোকানে জুতা সেলাই করাইতেছিলেন। এক বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিতে করিতে বলিলেন, “আমি দীনেশবাবুর বাড়ি যাব।” তাহা শুনিয়া আমি তাঁহাকে বলিলাম, “আমিও সেখানে যাব। আপনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেন কি?” তিনি আমাকে দীনেশবাবুর বাড়িতে লইয়া গেলেন। যে খাতাখানায় গ্রাম্য গানগুলি সংগ্রহ করিয়াছিলাম দীনেশবাবু সেই খাতাখানার কয়েকটি পাতা উলটাইয়া পালটাইয়া আমার মুখের দিকে চাহিলেন। আবার সেই খাতায় মনোনিবেশ করিলেন। তারপর আবার আমার মুখের দিকে চাহিলেন।

শ্রদ্ধায়-বিস্ময়ে আমার সকল অন্তর কম্পিত হইতেছিল। এই সেই ডাক্তার সেন, যাঁহার ‘বঙ্গ ভাষা ও সাহিত্য’ রাত জাগিয়া জাগিয়া পড়িয়াছি; পদ্মার তীরে কত গভীর রজনীতে যাঁর বই পড়িয়া, দারিদ্র্যের কাহিনী জানিয়া নিজের জীবনকে এক উচ্চতর আদর্শে গড়িয়া লইতে প্রতিজ্ঞা করিয়াছি। আমার সকল অন্তর সালাম হইয়া যেন তাঁহার সামনে লুটাইয়া পড়িতে চাহিতেছিল। আমি যেন এক গ্রহ হইতে আর এক নূতন গ্রহচক্রের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছি। এ জগতের সকলেই যেন অপার রহস্যে ভরা।

কিছুক্ষণ পরে ডাক্তার শহীদুল্লাহ্ সাহেবের হাতে একখানা কাগজ দিয়া দীনেশবাবু বলিলেন, “আমি যাহা বলি লিখে যাও। লেখ,- প্রিয় ডাঃ সেন, আপনাকে আমি একজন তরুণ যুবকের সঙ্গে পরিচিত করাইব। ইনি পাড়াগাঁ হইতে মুর্শিদা, বাউল, বারমাসী, মারফতি, জারি, ধুয়া প্রভৃতি নানা প্রকারের গ্রাম্য গান সংগ্রহ করিয়াছেন। আমি জানি, আপনি ছাড়া এমন কোনো ব্যক্তি নাই যাঁহার দ্বারা ইনি উৎসাহিত হইতে পারেন। আপনি যদি তাহাকে কাজে লাগাইতে পারেন বড়ই খুশি হইব।”

ডাক্তার শহীদুল্লাহ সাহেবকে দিয়া এই চিঠি লেখাইয়া তিনি আমাকে বলিলেন, “আমি তো তোমাদের জন্য এখানে বসে সাধনা করছি। মন্ত্র পড়ে তোমাদের কত ডেকেছি। তোমরা এতদিন আস নাই, এখন আমি বৃদ্ধ হয়েছি। আগে আসলে তোমাদের মতো যুবকদের অনেক কিছু করে দিতে পারতাম। তবু দেখা যাক কি করতে পারি। তোমাদের এই প্রশংসাপত্র নিয়ে আজ আমি বাংলার গভর্নর লর্ড লিটন সাহেবকে দেখাব। তুমি যাতে গান সংগ্রহ করে অন্তত মাসে ৭০ টাকা উপার্জন করতে পার সেই ব্যবস্থা করে দিব। কাল সকালে এসে তুমি খবর নিয়ে যেয়ো।”

চলবে…..