০২:৪১ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২১৮)

  • Sarakhon Report
  • ১১:০০:০৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ অগাস্ট ২০২৫
  • 100

দীনেশচন্দ্র

যখন আমি বি, এ, ক্লাসের ছাত্র তখন দীনেশবাবু আমাকে লিখিলেন, “তোমার সেই ‘কবর’ কবিতাটি নকল করে পাঠাও। আমি ‘ম্যাট্রিক সিলেকশনে’ জুড়ে দেব। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা ক্লাশের ছাত্রেরা পড়বে।” ইহার কিছুদিন পরে দীনেশবাবু লিখিলেন, “তোমার কবিতা ম্যাট্রিক ক্লাশে পাঠ্য হয়েছে। তোমার ছাত্রাবস্থায়ই তোমার কবিতার আদর হল, বাংলা দেশের আর কোনো সাহিত্যিকের ভাগ্যে তাহা ঘটে নাই।”

এইভাবে দীনেশবাবু ইন্দ্রজালের ভেলকির মতো আমাকে এক একটি অবস্থা হইতে তুলিয়া ধরিয়াছেন।

আমার ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ কবিতার পাণ্ডুলিপি পড়িয়া তিনি আমাকে উহা পুস্তকাকারে ছাপাইতে উৎসাহ দিলেন। এই পুস্তক ছাপাইতে দেরি হইতেছে দেখিয়া তিনি আমাকে এক পত্রে লিখিলেন, “তোমার পুস্তকখানা আমি বেঁচে থাকতে থাকতে ছাপিয়ে ফেল। এই পুস্তক

ছাপা হলে আমি উহার বিস্তৃত সমালোচনা করব। তাহাতে বাঙলা দেশের পাঠক-সমাজ তোমার বইয়ের আদর করবে। আমি মরে গেলে আমার মতো করে হয়তো তোমার বই-এর সমালোচনা আর কেহ করবে না।”

এই সময়ে দীনেশবাবু বহুমূত্র রোগে শয্যাশায়ী ছিলেন। ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ ছাপাইবার জন্য আমি কলিকাতা আসিলাম। এই পুস্তকের প্রকাশক ‘গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্সের’ সহিত দীনেশবাবুই আমাকে পরিচয় করাইয়া দিলেন। শয্যাশায়ী অবস্থায় দীনেশবাবুই এই পুস্তকের সমস্ত প্রুফ দেখিয়া দিলেন। গ্রন্থকারের নিবেদনে তাঁহার কথা আমাকে উল্লেখ করিতে নিষেধ করিয়া দিয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন, “আমার কাছে তুমি পুস্তক প্রকাশে সাহায্য পেয়েছ তাহা জানলে আমাকে যারা পছন্দ করে না তারা বই-এর নিন্দা করবে।” আমি বলিলাম, “তা করে করুক, আপনার নাম আমি উল্লেখ করবই।” কিন্তু দীনেশবাবু কিছুতেই আমাকে তাঁহার নাম প্রকাশ করিতে অনুমতি দিলেন না।

পুস্তকের প্রারম্ভে গ্রন্থকারের নিবেদনে আমি উল্লেখ করিলাম, ‘এই গ্রন্থ প্রকাশে যিনি সব চাইতে বেশি সাহায্য করেছেন, নিষেধ করেছেন বলে তাঁর নামটি উল্লেখ করলাম না’। দীনেশবাবু আশা করিয়াছিলেন এই পুস্তক প্রকাশিত হইলে বাঙলা দেশের আরও অন্যান্য সাহিত্যরসিকের দৃষ্টি ইহার প্রতি আকৃষ্ট হইবে এবং তাঁহারা এই পুস্তকের সুবিস্তৃত সমালোচনা বাহির করিবে। সেইজন্য তিনি পুস্তকের মধ্যে তাঁহার নাম উল্লেখ না করিতে এত পীড়াপীড়ি করিয়াছিলেন। পুস্তক প্রকাশিত হইল। দুই একখানা কাগজে কিছু কিছু সমালোচনাও হইল। কেহ লিখিলেন, “এই তরুণ লেখকের ভবিষ্যৎ কামনা করি।” কিন্তু এসব সমালোচনায় বই মোটেই বিক্রয় হইল না। প্রকাশক জানাইলেন, আমার পুস্তক দু একখানা মাত্র বিক্রয় হইয়াছে।

বলা বাহুল্য, নিজের ঘর হইতে পুস্তক প্রকাশের সম্পূর্ণ খরচ আমকে দিতে হইয়াছিল। খরচ বাবদ প্রেস আমার নিকট আরও কিছু পাইত। দীনেশবাবুকে বলিলাম, “বই মোটেই বিক্রয় হচ্ছে না। আপনি তো বলেছিলেন, এ বই বাংলাদেশের লোক আদর করবে। কিন্তু যে গতিতে বই বিক্রি হচ্ছে, তাতে আরও ২৫ বৎসরেও সমস্ত বই বিক্রি হবে না।”

 

চলবে…..

জনপ্রিয় সংবাদ

জেন জি এখন সুগন্ধি খুঁজছে

পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের স্মৃতিকথা (পর্ব-২১৮)

১১:০০:০৪ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ২৪ অগাস্ট ২০২৫

দীনেশচন্দ্র

যখন আমি বি, এ, ক্লাসের ছাত্র তখন দীনেশবাবু আমাকে লিখিলেন, “তোমার সেই ‘কবর’ কবিতাটি নকল করে পাঠাও। আমি ‘ম্যাট্রিক সিলেকশনে’ জুড়ে দেব। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা ক্লাশের ছাত্রেরা পড়বে।” ইহার কিছুদিন পরে দীনেশবাবু লিখিলেন, “তোমার কবিতা ম্যাট্রিক ক্লাশে পাঠ্য হয়েছে। তোমার ছাত্রাবস্থায়ই তোমার কবিতার আদর হল, বাংলা দেশের আর কোনো সাহিত্যিকের ভাগ্যে তাহা ঘটে নাই।”

এইভাবে দীনেশবাবু ইন্দ্রজালের ভেলকির মতো আমাকে এক একটি অবস্থা হইতে তুলিয়া ধরিয়াছেন।

আমার ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ কবিতার পাণ্ডুলিপি পড়িয়া তিনি আমাকে উহা পুস্তকাকারে ছাপাইতে উৎসাহ দিলেন। এই পুস্তক ছাপাইতে দেরি হইতেছে দেখিয়া তিনি আমাকে এক পত্রে লিখিলেন, “তোমার পুস্তকখানা আমি বেঁচে থাকতে থাকতে ছাপিয়ে ফেল। এই পুস্তক

ছাপা হলে আমি উহার বিস্তৃত সমালোচনা করব। তাহাতে বাঙলা দেশের পাঠক-সমাজ তোমার বইয়ের আদর করবে। আমি মরে গেলে আমার মতো করে হয়তো তোমার বই-এর সমালোচনা আর কেহ করবে না।”

এই সময়ে দীনেশবাবু বহুমূত্র রোগে শয্যাশায়ী ছিলেন। ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ ছাপাইবার জন্য আমি কলিকাতা আসিলাম। এই পুস্তকের প্রকাশক ‘গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্সের’ সহিত দীনেশবাবুই আমাকে পরিচয় করাইয়া দিলেন। শয্যাশায়ী অবস্থায় দীনেশবাবুই এই পুস্তকের সমস্ত প্রুফ দেখিয়া দিলেন। গ্রন্থকারের নিবেদনে তাঁহার কথা আমাকে উল্লেখ করিতে নিষেধ করিয়া দিয়াছিলেন। তিনি বলিয়াছিলেন, “আমার কাছে তুমি পুস্তক প্রকাশে সাহায্য পেয়েছ তাহা জানলে আমাকে যারা পছন্দ করে না তারা বই-এর নিন্দা করবে।” আমি বলিলাম, “তা করে করুক, আপনার নাম আমি উল্লেখ করবই।” কিন্তু দীনেশবাবু কিছুতেই আমাকে তাঁহার নাম প্রকাশ করিতে অনুমতি দিলেন না।

পুস্তকের প্রারম্ভে গ্রন্থকারের নিবেদনে আমি উল্লেখ করিলাম, ‘এই গ্রন্থ প্রকাশে যিনি সব চাইতে বেশি সাহায্য করেছেন, নিষেধ করেছেন বলে তাঁর নামটি উল্লেখ করলাম না’। দীনেশবাবু আশা করিয়াছিলেন এই পুস্তক প্রকাশিত হইলে বাঙলা দেশের আরও অন্যান্য সাহিত্যরসিকের দৃষ্টি ইহার প্রতি আকৃষ্ট হইবে এবং তাঁহারা এই পুস্তকের সুবিস্তৃত সমালোচনা বাহির করিবে। সেইজন্য তিনি পুস্তকের মধ্যে তাঁহার নাম উল্লেখ না করিতে এত পীড়াপীড়ি করিয়াছিলেন। পুস্তক প্রকাশিত হইল। দুই একখানা কাগজে কিছু কিছু সমালোচনাও হইল। কেহ লিখিলেন, “এই তরুণ লেখকের ভবিষ্যৎ কামনা করি।” কিন্তু এসব সমালোচনায় বই মোটেই বিক্রয় হইল না। প্রকাশক জানাইলেন, আমার পুস্তক দু একখানা মাত্র বিক্রয় হইয়াছে।

বলা বাহুল্য, নিজের ঘর হইতে পুস্তক প্রকাশের সম্পূর্ণ খরচ আমকে দিতে হইয়াছিল। খরচ বাবদ প্রেস আমার নিকট আরও কিছু পাইত। দীনেশবাবুকে বলিলাম, “বই মোটেই বিক্রয় হচ্ছে না। আপনি তো বলেছিলেন, এ বই বাংলাদেশের লোক আদর করবে। কিন্তু যে গতিতে বই বিক্রি হচ্ছে, তাতে আরও ২৫ বৎসরেও সমস্ত বই বিক্রি হবে না।”

 

চলবে…..