১০:৩৮ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২০ ডিসেম্বর ২০২৫
ছয় বছর পরও কি আমরা পরবর্তী মহামারির জন্য প্রস্তুত? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা (পর্ব-৭৫) একীভূত আইনি চুক্তির মাধ্যমে প্রতিরোধমূলক বিচার চীনের জলসীমায় স্টারলিংক ব্যবহার: বিদেশি জাহাজকে জরিমানা প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩৪২) সংযুক্ত আরব আমিরাতে অস্থির আবহাওয়া: বৃষ্টি ও দুর্ঘটনায় দুবাই–শারজাহজুড়ে সন্ধ্যায় তীব্র যানজট অসম্ভবকে সম্ভব মনে করা অভিনেত্রী মিনি ড্রাইভার, পঞ্চান্নেও ব্যস্ত ও আত্মবিশ্বাসী জীবন যে সিনেমাটি দেখতে আমি ভয় পেয়েছিলাম অস্ট্রেলিয়ার ক্ষত সারাতে লড়াই: বন্ডি বিচ হত্যাযজ্ঞের পর ঐক্য আর বিভাজনের সন্ধিক্ষণ ঢাকায় উদীচী কার্যালয়ে হামলার পর অগ্নিকাণ্ড

গাজীপুরে অপরাধের বিস্তার: সাত মাসে ১০২ খুনের পেছনের কারণ ও বাস্তবতা

বাংলাদেশের শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিচিত গাজীপুর আজ আতঙ্কের অন্য নাম হয়ে উঠেছে। রাজধানীর পাশের এই নগরীতে প্রতিদিনই ঘটছে খুন, ছিনতাই, সশস্ত্র হামলা ও মাদক-চাঁদাবাজির মতো ঘটনা। পুলিশের হিসাবে শুধু সাত মাসে সংঘটিত হয়েছে ১০২টি হত্যাকাণ্ড। এই সংখ্যা শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং একটি শহরের ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতার প্রতিচ্ছবি।

পরিসংখ্যানের ভয়াবহতা

চলতি বছরের সাত মাসে মহানগরের আট থানায় ৪৩ জন এবং জেলার চার থানায় ৫৯ জন খুন হয়েছেন। সব মিলিয়ে ১০২টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। গত বছর একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল অনেক কম। সদর থানায় সর্বাধিক ১১টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে।

এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে, অপরাধ শুধু বাড়ছেই না, বরং প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। নগরের ১৩ থানার মধ্যে জয়দেবপুর থানায় কোনো হত্যাকাণ্ড না ঘটলেও অন্য প্রায় সব এলাকায় সহিংসতার মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

ঘটনাগুলোর চিত্র

সম্প্রতি কয়েকটি হত্যাকাণ্ড গোটা জেলাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। সাংবাদিক হত্যার ঘটনা, শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমানকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা কিংবা পরিবহন শ্রমিকের মাথাবিহীন লাশ উদ্ধারের মতো ঘটনাগুলো শুধু অপরাধের নির্মমতাই নয়, অপরাধীদের সাহসিকতারও প্রমাণ। তারা প্রকাশ্য দিবালোকে, এমনকি পুলিশের সামনেও হামলা চালাতে দ্বিধা করছে না।

স্থানীয়দের অভিজ্ঞতা

নগরের সাধারণ মানুষ—পোশাকশ্রমিক, শিক্ষার্থী কিংবা চাকরিজীবী—প্রতিদিনই ভুক্তভোগী হচ্ছেন। অনেকে ছিনতাইয়ের পর থানায় গিয়ে অভিযোগ করতে চাইলে পুলিশ নিতে চায় না তারাও যেন ভয় পায়। ফলে ভুক্তভোগীরা নিরুপায় হয়ে নীরব থাকছেন। এভাবে সমাজে নীরবতার সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে, যা অপরাধীদের আরও বেপরোয়া করে তুলছে।

পুলিশের চ্যালেঞ্জ

মহানগর পুলিশের কমিশনার স্বীকার করেছেন, শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বহু মানুষ অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। বিশাল আয়তনের শহরে মাত্র ১১০০ পুলিশ সদস্য দিয়ে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৬৫ লাখ মানুষের জন্য প্রতি পুলিশ সদস্যকে দায়িত্ব নিতে হচ্ছে পাঁচ হাজার ৯০০ জনের।

এমন পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি তৈরি করছে। যদিও রাতে স্পর্শকাতর এলাকায় বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়, তবুও জনশক্তির ঘাটতি পূরণে এটি যথেষ্ট নয়।

অপরাধ বৃদ্ধির কারণ

১. অর্থনৈতিক কারণ: শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা মানুষকে অপরাধে ঠেলে দিচ্ছে।
২. আইনের দুর্বল প্রয়োগ: মামলা নিতে অনীহা, তদন্তে ধীরগতি ও বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি অপরাধীদের উৎসাহিত করছে।
৩. পুলিশি সংকট: জনবল কম, টহল কমে যাওয়া আইনশৃঙ্খলা দুর্বল করছে।
৪. সামাজিক ভীতি: মানুষ ভয়ে মামলা করে না, প্রকাশ্যে অভিযোগ জানায় না। ফলে অপরাধীরা আরও নির্ভয়ে কার্যক্রম চালায়।

প্রভাব

এই পরিস্থিতি শুধু মানুষের প্রাণহানি ঘটাচ্ছে না, বরং ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পোশাকশিল্প ও অন্যান্য শিল্পকারখানার মালিকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। একই সঙ্গে শ্রমিকরা ভয় নিয়ে কাজে যাচ্ছেন। দীর্ঘমেয়াদে এটি গাজীপুরের অর্থনৈতিক প্রাণশক্তিকে দুর্বল করতে পারে।

বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়

গাজীপুরের অপরাধ পরিস্থিতি এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার প্রতিফলন। জনবল সংকট, বিচারহীনতা ও সামাজিক ভীতি একসঙ্গে কাজ করছে। যদি এখনই প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ না নেয়, তবে গাজীপুর শুধু একটি শিল্পনগরী নয়, বরং দেশের সবচেয়ে বিপজ্জনক শহরে পরিণত হতে পারে।

জনপ্রিয় সংবাদ

ছয় বছর পরও কি আমরা পরবর্তী মহামারির জন্য প্রস্তুত?

গাজীপুরে অপরাধের বিস্তার: সাত মাসে ১০২ খুনের পেছনের কারণ ও বাস্তবতা

১২:৫৭:৪১ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৮ অগাস্ট ২০২৫

বাংলাদেশের শিল্পাঞ্চল হিসেবে পরিচিত গাজীপুর আজ আতঙ্কের অন্য নাম হয়ে উঠেছে। রাজধানীর পাশের এই নগরীতে প্রতিদিনই ঘটছে খুন, ছিনতাই, সশস্ত্র হামলা ও মাদক-চাঁদাবাজির মতো ঘটনা। পুলিশের হিসাবে শুধু সাত মাসে সংঘটিত হয়েছে ১০২টি হত্যাকাণ্ড। এই সংখ্যা শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং একটি শহরের ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তাহীনতার প্রতিচ্ছবি।

পরিসংখ্যানের ভয়াবহতা

চলতি বছরের সাত মাসে মহানগরের আট থানায় ৪৩ জন এবং জেলার চার থানায় ৫৯ জন খুন হয়েছেন। সব মিলিয়ে ১০২টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। গত বছর একই সময়ে এই সংখ্যা ছিল অনেক কম। সদর থানায় সর্বাধিক ১১টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে।

এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে যে, অপরাধ শুধু বাড়ছেই না, বরং প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। নগরের ১৩ থানার মধ্যে জয়দেবপুর থানায় কোনো হত্যাকাণ্ড না ঘটলেও অন্য প্রায় সব এলাকায় সহিংসতার মাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।

ঘটনাগুলোর চিত্র

সম্প্রতি কয়েকটি হত্যাকাণ্ড গোটা জেলাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। সাংবাদিক হত্যার ঘটনা, শিক্ষার্থী মাহফুজুর রহমানকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা কিংবা পরিবহন শ্রমিকের মাথাবিহীন লাশ উদ্ধারের মতো ঘটনাগুলো শুধু অপরাধের নির্মমতাই নয়, অপরাধীদের সাহসিকতারও প্রমাণ। তারা প্রকাশ্য দিবালোকে, এমনকি পুলিশের সামনেও হামলা চালাতে দ্বিধা করছে না।

স্থানীয়দের অভিজ্ঞতা

নগরের সাধারণ মানুষ—পোশাকশ্রমিক, শিক্ষার্থী কিংবা চাকরিজীবী—প্রতিদিনই ভুক্তভোগী হচ্ছেন। অনেকে ছিনতাইয়ের পর থানায় গিয়ে অভিযোগ করতে চাইলে পুলিশ নিতে চায় না তারাও যেন ভয় পায়। ফলে ভুক্তভোগীরা নিরুপায় হয়ে নীরব থাকছেন। এভাবে সমাজে নীরবতার সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে, যা অপরাধীদের আরও বেপরোয়া করে তুলছে।

পুলিশের চ্যালেঞ্জ

মহানগর পুলিশের কমিশনার স্বীকার করেছেন, শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বহু মানুষ অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। বিশাল আয়তনের শহরে মাত্র ১১০০ পুলিশ সদস্য দিয়ে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ৬৫ লাখ মানুষের জন্য প্রতি পুলিশ সদস্যকে দায়িত্ব নিতে হচ্ছে পাঁচ হাজার ৯০০ জনের।

এমন পরিস্থিতি স্বাভাবিকভাবেই আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ঘাটতি তৈরি করছে। যদিও রাতে স্পর্শকাতর এলাকায় বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করা হয়, তবুও জনশক্তির ঘাটতি পূরণে এটি যথেষ্ট নয়।

অপরাধ বৃদ্ধির কারণ

১. অর্থনৈতিক কারণ: শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া, বেকারত্ব ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা মানুষকে অপরাধে ঠেলে দিচ্ছে।
২. আইনের দুর্বল প্রয়োগ: মামলা নিতে অনীহা, তদন্তে ধীরগতি ও বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি অপরাধীদের উৎসাহিত করছে।
৩. পুলিশি সংকট: জনবল কম, টহল কমে যাওয়া আইনশৃঙ্খলা দুর্বল করছে।
৪. সামাজিক ভীতি: মানুষ ভয়ে মামলা করে না, প্রকাশ্যে অভিযোগ জানায় না। ফলে অপরাধীরা আরও নির্ভয়ে কার্যক্রম চালায়।

প্রভাব

এই পরিস্থিতি শুধু মানুষের প্রাণহানি ঘটাচ্ছে না, বরং ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পোশাকশিল্প ও অন্যান্য শিল্পকারখানার মালিকরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। একই সঙ্গে শ্রমিকরা ভয় নিয়ে কাজে যাচ্ছেন। দীর্ঘমেয়াদে এটি গাজীপুরের অর্থনৈতিক প্রাণশক্তিকে দুর্বল করতে পারে।

বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়

গাজীপুরের অপরাধ পরিস্থিতি এখন আর বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং একটি প্রাতিষ্ঠানিক ব্যর্থতার প্রতিফলন। জনবল সংকট, বিচারহীনতা ও সামাজিক ভীতি একসঙ্গে কাজ করছে। যদি এখনই প্রশাসন কঠোর পদক্ষেপ না নেয়, তবে গাজীপুর শুধু একটি শিল্পনগরী নয়, বরং দেশের সবচেয়ে বিপজ্জনক শহরে পরিণত হতে পারে।