ফুটবলের যাত্রা ভারতীয় উপমহাদেশে শুরু হয় উনবিংশ শতকে, মূলত ব্রিটিশদের হাত ধরে। ব্রিটিশ সৈন্য ও প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তাঁদের অবসর সময় কাটানোর জন্য ফুটবল খেলতে শুরু করেন। কলকাতা, শিলচর, ঢাকা-সহ বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় ব্রিটিশরা খেলাটি পরিচিত করে তোলেন। শুরুর দিকে ফুটবল ছিল একেবারেই “ইউরোপীয়” খেলা, যেখানে ভারতীয়রা শুধু দর্শকের ভূমিকায় থাকতেন।
কলকাতা: ফুটবলের প্রথম ঘাঁটি
১৮৫৪ সালে কলকাতায় প্রথমবারের মতো ফুটবল খেলার কথা পাওয়া যায়। ১৮৭২ সালে স্কটিশ ও ইংরেজদের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা হয়, যা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম দলগত ফুটবল ম্যাচ হিসেবে চিহ্নিত। এরপর কলকাতায় ধীরে ধীরে বেশ কিছু ক্লাব গড়ে ওঠে—এর মধ্যে ১৮৮৯ সালে প্রতিষ্ঠিত “মোহনবাগান অ্যাথলেটিক ক্লাব” ছিল এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।
![]()
ভারতীয়দের অংশগ্রহণ
প্রথমদিকে ভারতীয়রা ফুটবলে প্রবেশ করতে না পারলেও, উনবিংশ শতকের শেষভাগে তারা খেলাটির প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠেন। কলেজ ও স্থানীয় সংগঠনগুলোতে দল গঠন শুরু হয়। ১৮৮৮ সালে “ডুরান্ড কাপ” শুরু হয়, যা এশিয়ার প্রাচীনতম ফুটবল প্রতিযোগিতা। মোহনবাগান ১৯১১ সালে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টকে পরাজিত করে আইএফএ শিল্ড জয় করে ইতিহাস সৃষ্টি করে। এটি শুধু ফুটবল নয়, ভারতীয় জাতীয়তাবাদের এক প্রতীক হয়ে ওঠে।
পূর্ববঙ্গে ফুটবলের বিস্তার
ব্রিটিশ আমলে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটেও ফুটবলের বিস্তার ঘটে। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব এবং পরে আবাহনী-মোহামেডান প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ববাংলার ফুটবলকে আরও জনপ্রিয় করে তোলে। গ্রামীণ মেলায়ও ফুটবল প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করে।
প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচের সূচনা
ভারতীয় উপমহাদেশের ফুটবল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রবেশ করে বিংশ শতকের প্রথমভাগে। ভারত জাতীয় দল প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকে। ব্রিটিশ শাসন শেষ হওয়ার পর সদ্য স্বাধীন ভারতের খেলোয়াড়রা খালি পায়ে খেলে বিশ্বকে অবাক করে দেন। তারা ফ্রান্সের বিরুদ্ধে খেলায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও ২-১ গোলে হেরে যায়। এই ম্যাচকে ভারতীয় ফুটবলের আন্তর্জাতিক মঞ্চে প্রথম পদচিহ্ন হিসেবে ধরা হয়।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
পূর্ববাংলায় ফুটবল বিশেষভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে পাকিস্তান আমল থেকেই। ঢাকা স্টেডিয়াম (বর্তমান বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম) আন্তর্জাতিক মানের খেলার জন্য ব্যবহৃত হতে শুরু করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে ফুটবল দেশপ্রেমের প্রতীক হয়ে ওঠে। “স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল” ১৯৭১ সালে ভারতজুড়ে প্রীতি ম্যাচ খেলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অর্থ সংগ্রহ করে।
ফুটবল এই অঞ্চলের প্রধান আবেগে
ফুটবল শুধু একটি খেলা নয়, ভারতীয় উপমহাদেশে এটি ঔপনিবেশিক শাসন, জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতার আন্দোলনের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। ব্রিটিশ সৈন্যদের হাত ধরে শুরু হওয়া ফুটবল এখন এই অঞ্চলের অন্যতম প্রধান আবেগে পরিণত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকের ম্যাচ থেকে শুরু করে আজকের এশিয়ান কাপে ভারতের, বাংলাদেশের, পাকিস্তানের অংশগ্রহণ—সবই ফুটবলের সেই যাত্রার ধারাবাহিকতা।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















