কবি শামসুর রাহমান এর সঙ্গে ৮০’শ দশক থেকে তাঁর মৃত্যুর পূর্ব অবধি অনেক সময় কাটিয়েছি। কোনো কোনো বড় আড্ডায় সকাল ১১টা থেকে ডিনারের পরেও বেশ কিছু সময় তিনি থাকতেন। ওই সব আড্ডায় বা ব্যক্তিগতভাবে যখন তাঁর কাছে গেছি- কখনও মনে হয়নি তিনি খুব বেশি রাজনীতি সচেতন মানুষ। তিনি নিতান্তই কবি। এর বাইরে কিছু বলে মনে হতো না। গদ্য লিখতেন জীবিকার প্রয়োজনে, তবে তাতে যে খুব স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন – তা মনে হতো না। বরং কবিতাতেই তিনি খুশি থাকতেন।
তার পরেও তাঁর জীবনের শুরু থেকে শেষ অবধি অসংখ্য রাজনৈতিক কবিতা ও সময়ের প্রয়োজনের কবিতা- এমনকি রাজনীতির ভবিষ্যৎদ্রষ্টার স্থানে দাঁড়িয়েও তিনি কিছু কবিতা লিখেছেন। কেন যে তিনি এগুলো লিখেছেন, তা খুব বেশি ভেবে দেখেনি আগে।
সম্প্রতি এই প্রশ্নের উত্তর পেলাম ঐতিহাসিক মুনতাসীর মামুনের নেয়া আবদুল গাফফার চৌধুরীর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার পড়ে। সেখানে গাফফার চৌধুরী বলছেন, শামসুর রাহমান তাঁর সমসাময়িকদের মতো কখনও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না বা তিনি মোটেই রাজনীতির ধারেকাছে থাকতেন না। তার পরেও জাতির প্রয়োজনে, বা জাতি যখন তার অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে তখনই শামসুর রাহমান বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। আর এ বিষয়ে গাফফার চৌধুরী বলেছেন, শামসুর রাহমান ছিলেন শতভাগ একজন কবি। আর ‘সময়’ কবিকে দিয়ে অনেক কিছু কবির অজান্তে করিয়ে নেয়।
গাফফার চৌধুরীর এই কথা ধরে বলা যায়, এজন্যই মনে হয় কবিকে ত্রিকালদর্শী বা ঋষি বলা হয়।

গাফফার চৌধুরী ওই সাক্ষাৎকারে বলেন, পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই যখন বাংলাভাষার এ ধরনের পরিবর্তন শুরু হলো- “সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি” – এর পরিবর্তে “ফজরে উঠিয়া আমি দিলে দিলে বলি” – এ সময় শামসুর রাহমান একটি কবিতা লেখেন যার নাম “রূপালী স্নান”। এই কবিতার নামে ‘স্নান’ শব্দ ছাড়াও পরে আর দুটো লাইনে তিনি হিন্দি শব্দ ‘পানি’র বদলে ‘জল’ শব্দ ব্যবহার করেন। লাইন দুটো-
… দৈনন্দিন পৃথিবীর পথে চাইনি শুধু শুকনো রুটির টক স্বাদ আর তৃষ্ণার জল।
… সন্ধ্যা- নদীর আঁকাবাঁকা জলে মেঠো চাঁদ লিখে রেখে যায় কোন গভীর পাঁচালি-/
গাফফার চৌধুরীর ওই সাক্ষাৎকারে জানা যায় ওই কবিতাটি কবি শামসুর রাহমান প্রকাশের জন্যে পাঠিয়েছিলেন দৈনিক সংবাদে- কিন্তু একমাস পার হয়ে গেলেও যখন ছাপা হয় না সে সময়ে গাফফার চৌধুরী যান কবি আব্দুল গনি হাজারীর কাছে- যেহেতু কবি হাজারী তখন ওই পত্রিকার সাহিত্যপাতা দেখতেন।গাফফার চৌধুরি তাঁর কাছে জানতে চান, শামসুর রাহমানের কবিতাটি ছাপা হচ্ছে না কেন? কবি আব্দুল গনি হাজারী তাঁকে সান্ত্বনা দেন, ছাপা হবে বলে। তার পরেও ছাপা হয় না আরো কয়েক সপ্তাহ- সে সময়ে গাফফার চৌধুরী সংবাদে গেলে আব্দুল গনি হাজারীর অ্যাসিস্ট্যান্ট তাঁকে ফাইল খুলে দেখান- সেখানে ‘স্নান’ ও ‘জল’ শব্দের নীচে লাল কালি দিয়ে দাগ দেয়া। গাফফার চৌধুরীর আর বুঝতে বাকি থাকে না। পরে “কবিতা” পত্রিকায় এ কবিতাটি ছাপা হয়।
যেমন ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের বেশ পরে তিনি “ইকারুসের আকাশ” কবিতাটি লেখেন।
“পারতাম জলপাই আর বৃষমাংস খেয়ে,
পান করে চামড়ার থলে থেকে উজ্জ্বল মদিরা
এবং নিভৃতকুঞ্জে তরুণীকে আলিঙ্গনে মোহাবিষ্ট করে
ধারালো ক্ষুরের স্পর্শসুখ নিয়ে প্রত্যহ সকালে
সাধারণ মানুষের মতো গোচারণ, শস্যক্ষেত আর
সন্তান লালন করে কাটাতে সময়।

………
কখনও মৃত্যুর আগে মানুষ জানে না
নিজের সঠিক পরিণতি। পালকের ভাঁজে ভাঁজে
সর্বনাশ নিতেছে নিশ্বাস
জেনেও নিয়েছি বেছে অসম্ভব উত্তপ্ত বলয়
পাখা মেলবার, যদি আমি এড়িয়ে ঝুঁকির আঁচ
নিরাপদ নিচে উড়ে উড়ে গন্তব্যে যেতাম পৌঁছে
তবে কি পেতাম এই অমরত্বময় শিহরণ?
শামসুর রাহমানের এই কবিতা যে কত সত্য, তা আসলে এখন প্রমাণিত হচ্ছে। শেখ মুজিবুর রহমান নামক মানুষটি যদি সূর্যকে না ছুঁইতে চাইতেন। যদি গ্রীক মিথোলজির ইকারুসের মতো তিনি গলে যাবে জেনেও ওই পাখা নিয়ে সূর্যের দিকে ধাবিত না হতেন, তিনিও রাজপাটে বসতেন পাকিস্তানের কিছুদিনের জন্য। তবে নিজের ডানা পুড়ে যাবে জেনেও যা তিনি সৃষ্টি করেন- সেটাই এই কবিতার শেষ তিন লাইন-
“যেহেতু স্বেচ্ছায়
করেছি অমোঘ নির্বাচন
ব্যপ্ত জ্বলজ্বলে, ক্ষমাহীন, রুদ্র নিজস্ব আকাশ।
“নিজস্ব আকাশ” শামসুর রাহমানের এই শব্দদ্বয় নিয়ে ব্যাখ্যা করে বিষয় ও শব্দ ব্যবহারের এই স্বর্ণময়তাকে খাটো না করাই উচিত।
এরপরে আশির দশকে এসে কবি শামসুর রাহমান লিখলেন, আরেকটি কবিতা
“উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ”
যার চারটি লাইন-
“যেখানে এখন কেউ কারো চেনা নয়, কেউ কারো
ভাষা ব্যবহার আদৌ বোঝে না; দেখে না সে
উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরাণায়; মুক্তিযুদ্ধ,
হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়, বৃথা যায়।

কবি ত্রিকালদর্শী, কত আগে তিনি ঘুম-ভাঙানি গান গেয়েছিলেন। ঘুম ভেঙেছিলো কি ভাঙেনি তা দেখা তো আর কবির কাজ নয়।
তারপর মৃত্যুর কয়েক বছর আগে নব্বই দশকের মাঝামাঝি এসে তিনি লিখলেন আরেকটি কবিতা –
“একটি মোনাজাতের খসড়া”
এই কবিতার দ্বিতীয় প্যারার অংশ বিশেষ-
“হে- দ্বীন ও দুনিয়ার মালিক, চোখের পলকে,
হে- সর্বশক্তিমান আপনি আমাকে
এমন তৌফিক দিন যাতে আমি আপাদমস্তক মনে-প্রাণে একজন খাস রাজাকার
হয়ে যেতে পারি রাতারাতি। তাহলেই আমি সাত তাড়াতাড়ি
মঞ্জিল-মকসুদে পৌঁছে যাবো, এই চর্মচক্ষে
দেখে নেবো হাতিশালে হাতি আর
ঘোড়াশালে ঘোড়া আর আমার হাতে আমলকির মতো
এসে যাবে ‘সব পেয়েছি’র দেশের সওগাত”।
এই কবিতার শেষ প্যারাটির অংশ-
……
“হে- পাক পারওয়ার দিগার, হে- বিশ্বপালক,
আপনি এক লহমায়
একজন তুখোড় রাজাকার করে দিন। তাহলেই আমি
দ্বীনের নামে দিনের পর দিন তেলা মাথায়
তেল ঢালতে পারব অবিরল,
গরিবের গরিবী কায়েম রাখব চিরদিন আর
মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ের চামড়া দিয়ে
ডুগডুগি বানিয়ে নেচে বেড়াবো দ্বিগ্বিদিক আর সবার নাকের তলায়
একনিষ্ঠ ঘুণপোকার মতো অহর্নিশ
কুরে কুরে খাবো রাষ্ট্রের কাঠামো, অব-কাঠামো”।
প্রকৃত কবির থেকে যেমন ভবিষ্যৎ কেউ বেশি দেখতে পায় না তেমনি কবির হাতের ভাষার থেকে আর কোন ভাষা কারো হাতে থাকে না- তাঁর বক্তব্য ব্যাখ্যা করার। প্রয়োজনও পড়ে না ব্যাখ্যা করার। কারণ কবি তো মহাকালের রথে বসে সত্যের ছবিই আঁকেন। তাই কবি আগেই মোনাজাতের খসড়াটি তৈরি করে দিয়ে গেছেন।
লেখক: সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক, সারাক্ষণ, The Present World.

স্বদেশ রায় 



















