সম্প্রতি বাংলাদেশ সরকারের এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, দেশের ভেতর থেকে অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে হলে অন্তত ৫ বছর সময় লাগতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে এটি এক ধরনের আশ্বাসের বার্তা হলেও সাধারণ মানুষের মনে প্রশ্ন উঠেছে — আসলে এই সময়সীমা কতটা বাস্তবসম্মত? কারণ মানি লন্ডারিং বা অবৈধ অর্থপাচারের বিরুদ্ধে লড়াই একটি অত্যন্ত জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া।
মানি লন্ডারিং: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ হুন্ডি, শেল কোম্পানি, ভুয়া আমদানি-রপ্তানি বিল, ওভার-ইনভয়েসিং, আন্ডার-ইনভয়েসিং ইত্যাদির মাধ্যমে বিদেশে বিনিয়োগের নামে পাচার হয়ে থাকে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন গ্লোবাল ফিনান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (GFI), ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন গবেষণা বলছে — বাংলাদেশ থেকে গত কয়েক দশকে কয়েক হাজার কোটি ডলার পাচার হয়ে গেছে।
এই অর্থ বিদেশের বিভিন্ন ব্যাংক, সম্পদ বিনিয়োগ কিংবা ব্যবসায় ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে শুধু টাকা চিহ্নিত করাই নয়, সেটি ফেরত আনার জন্য শক্তিশালী আন্তর্জাতিক সহযোগিতা অপরিহার্য।
অর্থ ফেরত আনার আইনি ও কূটনৈতিক বাধা
আন্তর্জাতিক আইন ও চুক্তির সীমাবদ্ধতা
যে দেশগুলোতে বাংলাদেশি পাচারকারীরা অর্থ রেখেছে, তাদের অনেকের ব্যাংকিং আইন অত্যন্ত গোপনীয়তানির্ভর। যেমন — সুইস ব্যাংকিং সিস্টেমে হিসাবধারীর পরিচয় জানানোই কঠিন। বাংলাদেশ চাইলে সরাসরি অর্থ ফেরত আনতে পারে না। এজন্য দ্বিপাক্ষিক চুক্তি, আন্তর্জাতিক কনভেনশন এবং আদালতের নির্দেশনার ওপর নির্ভর করতে হয়।

আইনি প্রমাণ সংগ্রহ
অর্থ ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমেই প্রমাণ করতে হবে যে টাকাটি অবৈধভাবে পাচার করা হয়েছে। অর্থ পাচারের চক্র অত্যন্ত জটিল। একটি টাকার অঙ্ক অনেক সময় এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরিত হতে হতে শেষ পর্যন্ত বৈধ ব্যবসার মধ্যে ঢুকে যায়। তখন আইনি প্রমাণ উপস্থাপন করাই হয়ে ওঠে প্রধান বাধা।
কূটনৈতিক চাপ ও সদিচ্ছা
যে দেশগুলোতে পাচারকৃত অর্থ রাখা আছে, সেসব দেশের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সহযোগিতা না পেলে অর্থ ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এজন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করা, যা সময়সাপেক্ষ এবং জটিল।
এতদিনে বাংলাদেশের সাফল্য বা ব্যর্থতা
বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত অর্থপাচার প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও বাস্তবে উল্লেখযোগ্য কোনো অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেনি।
- ২০১২ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের হিসাব নিয়ে আলোচনার পর কিছু তথ্য মিলেছিল,কিন্তু সেই অর্থ ফেরত আনা যায়নি।
- দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট একাধিকবার তদন্ত শুরু করেছে,কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে ফলাফল হয়নি।
- আন্তর্জাতিক সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ বারবার ব্যর্থ হয়েছে। ফলে এতদিনে পাচার হওয়া বিপুল অর্থের পুনরুদ্ধারের সাফল্য প্রায় শূন্য।
বছরের মধ্যে ফেরত আনা কি সম্ভব?
সরকারি মুখপাত্র যে সময়সীমার কথা বলেছেন — তা একটি আশাবাদী চিত্র। তবে বাস্তবতা অনেক কঠিন।
কিছু অর্থ হয়তো চিহ্নিত করে আংশিকভাবে ফেরত আনা সম্ভব।
কিন্তু সব অর্থ ফেরত আসা বাস্তবসম্মত নয়।
কারণ এর অনেকটাই বিদেশে সম্পদ, ব্যবসা বা অন্য বিনিয়োগে মিশে গেছে।

আবার কিছু অর্থ বহু দেশের মধ্যে ঘুরে গিয়ে “লিগ্যাল ইকোনমি”-র অংশ হয়ে পড়েছে।
ফলে পাঁচ বছরের মধ্যে অর্থ ফেরত আনার ঘোষণা রাজনৈতিক বার্তা হিসেবে কাজ করতে পারে, কিন্তু বাস্তবে এটি পূর্ণাঙ্গভাবে অর্জন করা কঠিন।
আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অর্থপাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেও খুব বেশি সফল হয়নি। উদাহরণস্বরূপ —
- নাইজেরিয়া,ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলোও পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার জন্য কয়েক দশক ধরে লড়াই করছে।
- কখনো কোনো অঙ্ক ফেরত এসেছে,তবে তা সম্পূর্ণ অর্থ নয়, বরং একটি ক্ষুদ্র অংশ।
এ থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশও দীর্ঘ মেয়াদি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য।
বাংলাদেশ সরকার যে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার জন্য পদক্ষেপ নিচ্ছে, সেটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তবে মুখপাত্রের দেওয়া ৫ বছরের সময়সীমা বাস্তবে কতটা সফল হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ এক টাকাও উল্লেখযোগ্যভাবে ফেরত আনতে পারেনি। তাই আগামী ৫ বছরে কিছু অর্থ ফিরতে পারে, কিন্তু সবটাই ফেরত আসবে — এমন আশা রাখা অবাস্তব। এটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধ, যেখানে আইনি, কূটনৈতিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সব ধরনের বাধা অতিক্রম করতে হবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















