ঐতিহ্য থেকে আধুনিকতার পথে সুঝৌ
চীনের জিয়াংসু প্রদেশের ঐতিহাসিক শহর সুঝৌ বহু শতাব্দী ধরে খ্যাত তার প্রাচীন খাল ও মনোরম উদ্যানের জন্য। তবে এখন শহরটির লক্ষ্য নতুন—বিশ্বের অন্যতম বায়োটেকনোলজি শক্তিকেন্দ্র হয়ে ওঠা। ২০১৮ সালে সুঝৌ ঘোষণা দেয়, ২০৩০ সালের মধ্যে তারা হবে “চায়নার ফার্মা ভ্যালি”, যেখানে উচ্চাকাঙ্ক্ষার মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বস্টনকে ঘিরে গড়ে ওঠা বায়োটেকনোলজি ইকোসিস্টেমকে সামনে রেখে।
বর্তমানে চীন-সিঙ্গাপুর সুঝৌ ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক শহরটির প্রযুক্তি ও গবেষণার কেন্দ্র। এখানে রয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ন্যানোপ্রযুক্তি, বায়োমেডিসিনসহ নানা খাতের কোম্পানি। ইতোমধ্যে এখানে ৩,৮০০ বায়োফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। লক্ষ্য হলো শীর্ষ স্থানীয় দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে আঞ্চলিক কার্যালয় স্থাপনে উৎসাহিত করা, যেখানে প্রতিটি কোম্পানিকে সর্বোচ্চ ৬ কোটি ইউয়ান (প্রায় ৮.৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার) পর্যন্ত ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে।
২০৩০ সালের ভিশন
শহরটির পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে সুঝৌতে ১০ হাজারেরও বেশি বায়োমেডিকেল কোম্পানি থাকবে এবং এর মোট উৎপাদনমূল্য ছাড়িয়ে যাবে ১ ট্রিলিয়ন ইউয়ান (প্রায় ১৩৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। শহরের প্রাক্তন পার্টি প্রধান ল্যান শাওমিন ২০২০ সালের এক সম্মেলনে বলেছিলেন, “আমরা প্রথম শহর, যারা নিজেদের বস্টনের সমান উচ্চতায় তুলতে চাইছি।”
মানবসম্পদ ও শিক্ষা
ভবিষ্যতের ঔষধ উদ্ভাবক তৈরি করতে সুঝৌর শিয়ান জিয়াওতং-লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয় (XJTLU) ২০২০ সালে প্রতিষ্ঠা করে উইজডম লেক একাডেমি অব ফার্মেসি। একাডেমির নির্বাহী ডিন ফু লেই বলেন, সফল বায়োটেক হাব গড়ে তুলতে শুধু কোম্পানি নয়—মানবসম্পদ, প্রশিক্ষণ, উৎপাদন, আইন ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থার পূর্ণ ইকোসিস্টেম প্রয়োজন।
তিনি উদাহরণ দেন যুক্তরাষ্ট্রের বস্টনের, যেখানে ১,০০০-এর বেশি বায়োটেক প্রতিষ্ঠান, আর হার্ভার্ড, এমআইটি’র মতো খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণায় সহায়তা করে। বস্টনের কেমব্রিজের কেন্ডাল স্কয়ারকে বলা হয় “পৃথিবীর সবচেয়ে উদ্ভাবনী এক বর্গমাইল”।
উদ্ভাবনের শিক্ষা ও নতুন পথচলা
ফু লেই ব্যাখ্যা করেন, চীনে আগে ফার্মেসি শিক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল জেনেরিক ওষুধ তৈরি। কিন্তু এখন দেশটি ধাপে ধাপে উদ্ভাবনী ওষুধের দিকে যাচ্ছে। এজন্য শিক্ষার্থীদের ঔষধ রসায়ন, বায়োস্ট্যাটিস্টিকস এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল নকশায় দক্ষ হতে হবে।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে পিএইচডি করা ফু প্রায় এক দশক যুক্তরাষ্ট্রে কাজ করে ২০০৬ সালে চীনে ফেরেন। তিনি মনে করেন, চীনে বর্তমানে উদ্ভাবনের নেতৃত্বে আছে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলো, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক গবেষণা থেকেই অনেক স্টার্টআপ তৈরি হয়।
শিল্পখাতের অগ্রগতি ও আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা
ফু লেই জানান, পশ্চিমে শিক্ষাপ্রাপ্ত অনেক গবেষক দেশে ফিরে আসায় উদ্ভাবনী ওষুধ তৈরিতে নতুন গতি এসেছে। তারা উন্নত প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতি এনেছেন, যা স্থানীয় বিজ্ঞানীদের কাজে লাগছে। চীনে এখন মেধাস্বত্ব সুরক্ষা শক্তিশালী হওয়ায় গবেষকরা নতুন আবিষ্কার দেশে নিবন্ধন করতে আগ্রহী হচ্ছেন।
তিনি বলেন, “চীন এক সময় ছিল একেবারে সাদা ক্যানভাস। আমি দেখেছিলাম এখানে পেশাগত উন্নতির সুযোগ, সরকারের নীতি সহায়তা এবং জ্ঞান ভাগাভাগি করার বিশাল ক্ষেত্র।”
শিক্ষার্থীদের অর্জন
এই বছর একাডেমি থেকে প্রথম ব্যাচের বায়োস্ট্যাটিস্টিকস শিক্ষার্থী স্নাতক হয়েছে। প্রায় ৫০ জন শিক্ষার্থী বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০০টিরও বেশি মাস্টার্স ও পিএইচডি প্রোগ্রামে সুযোগ পেয়েছে।
স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ পাচ্ছে বায়োস্ট্যাটিস্টিকস, মেডিসিনাল কেমিস্ট্রি, ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্স এবং এআই-ভিত্তিক ড্রাগ ডিসকভারি বিষয়ে।
এআই-এর বিপ্লবী ভূমিকা
ফু লেই মনে করেন, এআই ফার্মাসিউটিক্যাল গবেষণায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনবে। তিনি একটি প্রকল্পের উদাহরণ দেন, যেখানে আলঝেইমার ও পারকিনসন রোগ নিয়ে গবেষণায় ব্যবহৃত ক্ষুদ্র কৃমি সি. এলিগান্স পর্যবেক্ষণে এআই ব্যবহার করা হচ্ছে। আগে বিজ্ঞানীরা মাইক্রোস্কোপে দীর্ঘ সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করতেন, এখন এআই একসঙ্গে শতাধিক নমুনা বিশ্লেষণ করতে পারে। ফলে এক মাসের কাজ দুই দিনে শেষ হচ্ছে।
এছাড়া বিশাল ডেটা বিশ্লেষণ করে এআই নতুন যৌগ তৈরির সম্ভাবনা তৈরি করছে। ফু বলেন, জীববিজ্ঞান ও ক্লিনিক্যাল তথ্যকে এআই-কে শেখানো গেলে লক্ষ্যভিত্তিক ওষুধ আবিষ্কারে নতুন দ্বার খুলে যাবে।
এইভাবে সুঝৌ ধীরে ধীরে চীনের বায়োটেক রাজধানীতে পরিণত হওয়ার পথে এগোচ্ছে। ঐতিহ্যের শহর এখন চাইছে আধুনিক বিজ্ঞানের বিশ্বমঞ্চে জায়গা করে নিতে।