সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মানুষের স্মৃতিকে বিকৃত করতে পারে। ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) ও ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় আরভিনের গবেষকরা জানিয়েছেন—চ্যাটবট, বিভ্রান্তিকর সারাংশ, পরিবর্তিত ছবি বা ভিডিও মানুষের স্মৃতিকে ভুল পথে পরিচালিত করতে সক্ষম।
গবেষণায় সবচেয়ে বেশি বিকৃত স্মৃতির শিকার হয়েছেন তারা, যারা এআই-সৃষ্ট ছবি থেকে তৈরি ভিডিও দেখেছেন। অর্থাৎ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের মনে এমন সব ঘটনা তৈরি করতে পারে, যা বাস্তবে কখনো ঘটেনি।
এলিজাবেথ লফটাসের দীর্ঘ গবেষণা
প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানী এলিজাবেথ লফটাস ৫০ বছর ধরে দেখিয়ে আসছেন, কী ভাবে মানুষকে এমন ঘটনার স্মৃতি মনে করানো যায়, যা কখনো ঘটেনি। যেমন—শৈশবে বাজারে হারিয়ে যাওয়া কিংবা নির্দিষ্ট খাবার খেয়ে অসুস্থ হওয়ার ভ্রান্ত স্মৃতি। এসব প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও অনেকেই মনে করেন, স্মৃতি ঠিক টেপ রেকর্ডারের মতো নির্ভুল থাকে। কিন্তু বাস্তবে মস্তিষ্ক স্মৃতিকে টুকরো টুকরো তথ্য জোড়া দিয়ে তৈরি করে। এতে মিথ্যা তথ্যও যুক্ত হতে পারে।
লফটাস জানান, অনেকেই ভুলভাবে ধরে নেন যে ভুলে যাওয়া মানে স্মৃতি মুছে যাওয়া বা ফিকে হয়ে যাওয়া। কিন্তু বাস্তবে মস্তিষ্ক নতুন তথ্যও যোগ করতে পারে, যা একেবারেই মিথ্যা।

এআই-ভিত্তিক প্রশ্নের প্রভাব
গবেষণার প্রথম পরীক্ষায় দেখা গেছে, চ্যাটবট জেরা করার সময় প্রশ্নের মধ্যে ভুল তথ্য গেঁথে দিলে সাক্ষীরা ভ্রান্ত স্মৃতি তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি সশস্ত্র ডাকাতির ভিডিও দেখানো হয় অংশগ্রহণকারীদের। পরে কিছু প্রশ্নে ভুল তথ্য রাখা হয়—যেমন, “চোরেরা যে গাড়ি করে এসেছিল, তার পাশে কী সিসিটিভি ক্যামেরা ছিল?” বাস্তবে কোনো গাড়ি ছিল না। তবুও প্রায় এক-তৃতীয়াংশ অংশগ্রহণকারী মনে করেছিলেন তারা গাড়ি দেখেছেন। এক সপ্তাহ পরও এই ভ্রান্ত স্মৃতি টিকে ছিল।
যারা এআই চ্যাটবট থেকে বিভ্রান্তিকর প্রশ্ন পেয়েছিলেন, তারা লিখিত প্রশ্ন পাওয়া অংশগ্রহণকারীদের তুলনায় প্রায় ১.৭ গুণ বেশি ভ্রান্ত স্মৃতি গড়ে তুলেছিলেন।
বিভ্রান্তিকর সারাংশ ও আত্মবিশ্বাস হারানো
দ্বিতীয় পরীক্ষায় প্রমাণ মিলেছে, এআই চ্যাটবট বা বিভ্রান্তিকর সারাংশ মানুষের মধ্যে মিথ্যা তথ্য ঢুকিয়ে দিতে পারে। আরও উদ্বেগজনক হলো, এতে অংশগ্রহণকারীরা আসল তথ্য কম মনে রাখতে পেরেছেন এবং সত্যিকারের তথ্য নিয়েও তাদের আত্মবিশ্বাস কমে গেছে।

ছবি ও ভিডিওর মাধ্যমে মিথ্যা স্মৃতি
তৃতীয় পরীক্ষায় ২০০ জন অংশগ্রহণকারীকে চার ভাগে ভাগ করা হয়। প্রথম দল দেখেছে আসল ছবি, দ্বিতীয় দল এআই-পরিবর্তিত ছবি, তৃতীয় দল সেই পরিবর্তিত ছবি থেকে বানানো ভিডিও, আর চতুর্থ দল পুরোপুরি এআই-তৈরি ছবি থেকে বানানো ভিডিও।
সবাই কিছু ভুল স্মৃতি তৈরি করলেও, এআই-পরিবর্তিত কনটেন্ট দেখা অংশগ্রহণকারীদের ক্ষেত্রে ভুলের হার ছিল অনেক বেশি। সবচেয়ে বেশি বিকৃতি দেখা গেছে যারা এআই-তৈরি ছবি থেকে তৈরি ভিডিও দেখেছেন তাদের মধ্যে।
গবেষণায় দেখা যায়, তরুণরা তুলনামূলকভাবে বেশি ভ্রান্ত স্মৃতি গড়ে তোলে, যদিও শিক্ষার স্তর এতে তেমন প্রভাব ফেলে না। উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো—অংশগ্রহণকারীরা জানতেন যে কনটেন্টগুলো এআই-তৈরি, তবুও তাদের স্মৃতিতে বিভ্রান্তি এসেছে।
বাস্তবতাকে পাল্টানোর ঝুঁকি
ছবির কিছু পরিবর্তন ছিল সূক্ষ্ম, যেমন—একটি জনসমাগমে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি যোগ করা বা আবহাওয়া বদলে দেওয়া। গবেষকরা জানান, কার্যকর বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে হলে অন্তত ৬০% সত্য তথ্যের সঙ্গে মিথ্যা জুড়ে দিতে হয়।

এটি শুধু ভুয়া খবর ছড়ানো নয়, বরং মানুষের বাস্তবতার বোধকেই পাল্টে দেওয়ার সামর্থ্য রাখে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম যেমন ভ্রান্ত ধারণা বা ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে জনপ্রিয় মনে করায়, এআই চ্যাটবটও আরও সূক্ষ্মভাবে মানুষের বিশ্বাস ও স্মৃতি প্রভাবিত করতে পারে।
সতর্ক থাকার আহ্বান
গবেষকরা বলছেন, নতুন তথ্য ও শক্তিশালী যুক্তি দিয়ে মত পরিবর্তন হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু যদি আমাদের চোখে দেখা, মনে রাখা কিংবা অনুভব করার ক্ষমতাই বিকৃত করা হয়, তবে তা বিপজ্জনক। এআই আমাদের মস্তিষ্কে নতুন স্মৃতি ঢুকিয়ে দিতে পারে—যা সত্য নয়, তবুও আমরা বিশ্বাস করি।
এই গবেষণা দেখাচ্ছে, প্রযুক্তির প্রভাবে শুধু মিথ্যা তথ্য ছড়ানো নয়, বরং মানুষের চিন্তা ও স্মৃতির মূল কাঠামোই বদলে যেতে পারে। তাই এ বিষয়ে সামাজিক ও বৈজ্ঞানিক পরিসরে গভীর আলোচনা জরুরি।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















