রায়েরবাজার (ঢাকা), যা আজকের মোহাম্মদপুর থানার অংশ, মূলত মাটির শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। এখানে ‘লালপাটি’ নামে পরিচিত উচ্চমানের রক্তাভ মাটি সহজলভ্য ছিল, যা মৃৎশিল্পীদের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান উৎস। মুঘল শাসনামলে এই এলাকা ‘কুমারটোলি’ নামে পরিচিত ছিল, মূলত এখানে কুমোর বা কুমাররা বসবাস করতেন।
উৎপাদন ও বাণিজ্য
প্রায় দুইশ বছর আগে পর্যন্ত এ অঞ্চলে মাটির নানা ধরনের পাত্র নির্মাণ প্রচলিত ছিল—মাটির দেবমূর্তি, মাটির খেলনা, টব, টাইলস, পিচার, পট, হারি, কড়াই, শঙ্খী, মাটির ধরা-বাঁধা, মাটির ফুলের টব, ফুলেল, জলপাত্র—বলা যায় প্রায় সকল ধরনের দৈনন্দিন ও প্রয়োজনে ব্যবহৃত সামগ্রীই তৈরি হতো।
তাছাড়া, তুরাগ নদীর কোল ঘেঁষে অবস্থিত হওয়ায় কাঁচামাটি সহজলভ্য ছিল এবং নদীপথে পরিবহন সুবিধা থাকায় উৎপাদিত পাত্রগুলো সহজেই বিতরণ ও বিপণনের জন্য পরিবহন করা যেত।

বিলুপ্তির কারণ
বর্তমানে রায়েরবাজারের পারিবারিক মৃৎশিল্প প্রায় বিলুপ্তির দিকে। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে—লোহা ও প্লাস্টিক জাতীয় বিকল্প সামগ্রীর প্রসার, চাহিদার ব্যাপক হ্রাস, প্রবীণ শিল্পীদের প্রেরণার অভাব এবং প্রযুক্তিগত ও আর্থিক অবকাঠামোর সংকট অন্যতম।
বাংলাদেশের কোন অঞ্চলের ঐতিহ্য এবং অন্যান্য প্রভাবিত অঞ্চলের অবস্থান
বাংলাদেশে মৃৎশিল্পের কেন্দ্রীয় অবস্থান রয়েছে।বাংলাদেশে মাটি থেকে তৈরি পাত্র বা মৃৎশিল্প একটি দীর্ঘকালীন ঐতিহ্য। এর উৎপত্তি ভারতের হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোর সভ্যতা যুগেও পাওয়া যায়—যেমন বগুড়ার মহাস্থানগড়, পীরপুকুর, কমলা গ্রামের পাথরের শিল্পকর্ম এবং দেবতার মূর্তি প্রভৃতি।
বিশেষভাবে ঢাকার আঞ্চলিক পর্যায়ে
দমরাই (কাকরান, কুমারপাড়া), বগুড়ার অরিয়া কুমারপাড়া, এবং রায়েরবাজার—এই তিনটি প্রধান মৃৎশিল্প গ্রাম হিসেবে পরিচিত ছিল।

অন্যান্য প্রভাবিত অঞ্চল ও অবস্থা
ধামরাই (ঢাকা) ও বগুড়া জেলার শিল্পীগোষ্ঠী এখনও সক্রিয় রয়েছে, যেখানে কিছু পরিবার প্রচলিত পদ্ধতিতে পাত্র তৈরির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে রায়েরবাজারের তুলনায় এই অঞ্চলে মৃৎশিল্প কিছুটা টিকে আছে।
বিপণন, রপ্তানি ও বর্তমান অবস্থা
বিপণন ও রপ্তানি
আগে রায়েরবাজারের শিল্পীরা শুধু ঢাকা বা আশেপাশের বাজারে বিক্রি করতেন। কিন্তু বর্তমানে, বাউফলের কুমারপাড়ার শিল্পীরা অনেক উন্নয়ন করেছেন—নতুন ডিজাইন, প্যাকেজিং, সমবায় গঠন এবং বৈদেশিক বাজারে রপ্তানি পর্যন্ত এগিয়ে গেছেন।
বর্তমান অবস্থা

এখন বলা যায়, রায়েরবাজার মৃৎশিল্প প্রায় বিলুপ্ত। তবে এখনও কিছু শিল্পী—যেমন প্রতীকৃষ্ণ পাল ‘পরান বাবু’—মাটির তন্দুরি চুলা ও অন্যান্য পাত্র তৈরি করে নিজ উদ্যোগে ঐতিহ্য ধরে রাখতে চেষ্টা করছেন। তিনি বয়সের ভারেও এই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু বংশপরম্পরায় কেউ নেই যারা এটি অব্যাহত রাখবে।
ঐতিহ্য: মুঘল শাসনামলের ‘কুমারটোলি’ থেকে রায়েরবাজারের মৃৎশিল্পে উৎপাদনের দীর্ঘ ঐতিহ্য গড়ে ওঠে।
উৎপাদন বৈচিত্র্য: গামলা, দেবদেবীর মূর্তি থেকে শুরু করে রান্নার পাত্র, শঙ্খী প্রভৃতি নানা সামগ্রী প্রস্তুত হতো।
বিলুপ্তির কারণ: প্রযুক্তিগত পশ্চাদপদতা, ন্যূনতম আর্থিক ও বিপণন সহায়তার অভাব, স্টিল ও প্লাস্টিক বিকল্পের আধিপত্য।
অন্য কেন্দ্র: ধামরাই ও বগুড়া এখনও কিছু পরিমাণে টিকে আছে।
ভবিষ্যৎ পথ: ডিজাইন ও প্রযুক্তি উন্নয়ন, প্রশিক্ষণ, সহায়তা, সমবায় গঠন এবং বৈদেশিক ও অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রবেশ—এসব উদ্যোগ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মূল্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















