০৫:২৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫
বেতনা নদী: সাতক্ষীরা, খুলনার একটি ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক রত্ন আবার ফিরছে ‘গ্রেমলিনস’, ২০২৭ ছুটির মৌসুমে ওয়ার্নার ব্রসের ঘোষণা মৃত্যু বাই লাইটনিং: গারফিল্ড হত্যার রহস্য ও নাটক আত্মবিশ্বাসই মূলধন: ‘প্রিটি প্রিভিলেজ’ নিয়ে ফিরলেন আইস স্পাইস মিয়ামি বিচে এখন ১,০০০ ডলারে কী করা যায় জাপানে প্রতিবন্ধী কর্মীদের জন্য কোম্পানির সহায়তা বৃদ্ধি চেন জির প্রতারণার সাম্রাজ্য: কিভাবে কেপাম্বোডিয়া থেকে লন্ডন পর্যন্ত বিস্তার লাভ করলেন অভিযুক্ত অপরাধী ফিলিপাইনের পর ভিয়েতনামে আঘাত কালমেগির, জলবায়ু আলোচনায় নতুন চাপ K-pop ব্যান্ড NEWBEAT-এর “LOUDER THAN EVER”: একটি নতুন পথচলা কাঁকড়ায় ভরা দ্বীপে গুগলের নতুন প্রকল্প, সামরিক ঘাঁটি নয় দাবি কোম্পানির

মুঘলাই পরোটা কীভাবে ঢাকায় এলো

মুঘলাই পরোটা মূলত মুঘল দরবারের খাবার সংস্কৃতি থেকে এসেছে। ১৬শ শতাব্দী থেকে মুঘল সম্রাটরা দিল্লি, আগ্রা ও পরে বাংলায় নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেন। মুঘল রান্নাঘরে মাংস, ঘি, দুধ, বাদাম, ডিম ইত্যাদি ব্যবহার করে ভারী ও সমৃদ্ধ খাবারের প্রচলন তৈরি হয়। এই ধারায় “ভরাট পরোটা” বা মাংস-ডিম দিয়ে ভাজা পরোটা প্রথম প্রচলিত হয়।

বাংলায় আগমন

১৭শ শতকের শুরুতে বাংলায় মুঘল সুবেদার ইসলাম খান চিশতি রাজধানী ঢাকায় স্থাপন করেন (১৬১০ খ্রিস্টাব্দে)। এরপর থেকেই মুঘল প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে ঢাকায় বহু উত্তর ভারতীয় বাবুর্চি ও খাওয়াদাওয়ার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। তাদের হাতেই মুঘলাই রান্নার নানা রকম রেসিপি ঢাকায় প্রবেশ করে। মুঘলাই পরোটা সেই সময় থেকেই ঢাকার বাজার ও নবাবদের খাবার টেবিলে জায়গা করে নেয়।

নবাবি দরবার ও ঢাকার খাবার সংস্কৃতি

১৮শ ও ১৯শ শতকে ঢাকার নবাবি পরিবারগুলো, বিশেষত নবাব সলিমুল্লাহর আমলে, দিল্লি ও লখনৌর বাবুর্চিদের ঢাকায় আনেন। এই বাবুর্চিরা কাবাব, বিরিয়ানি, কোরমা ও মুঘলাই পরোটাকে বিশেষ জনপ্রিয় করে তোলেন। মাংস বা কিমা দিয়ে ভরা ডিম-লেপা এই পরোটা নবাবি ভোজসভায় মর্যাদার সঙ্গে পরিবেশিত হতো।

সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা

প্রথমে মুঘলাই পরোটা নবাবি ও অভিজাত শ্রেণির খাবার হলেও ১৯শ শতকের শেষ দিকে এবং ২০শ শতকের শুরুতে এটি ঢাকার রাস্তাঘাট ও বাজারে বিক্রি হতে শুরু করে। পুরান ঢাকার দোকানগুলোতে ডিম ও কিমা দিয়ে তৈরি বড় মাপের ভাজা পরোটা ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের প্রিয় নাস্তা হয়ে ওঠে। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী, অফিসপাড়া, এমনকি হাটে-ঘাটের মানুষও দ্রুত এটি গ্রহণ করে।

পুরান ঢাকার দোকান ও এলাকার ঐতিহ্য

ঢাকায় মুঘলাই পরোটার জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু এলাকা বিখ্যাত হয়ে ওঠে। পুরান ঢাকার নাজিরাবাজার, চকবাজার, আজিমপুর, চানখারপুল ও বাংলাবাজারের দোকানগুলো দীর্ঘদিন ধরে মুঘলাই পরোটা পরিবেশন করে আসছে। বিশেষ করে রাতের বেলায় চকবাজারে রমজানের ইফতারের সময় এই খাবারের ব্যাপক চাহিদা দেখা যায়। অনেক পুরনো দোকান দাবি করে, নবাবি আমলের বাবুর্চিদের হাত ধরেই তারা এই রেসিপি পেয়েছিল। তাই আজও পুরান ঢাকার মুঘলাই পরোটা ঢাকাবাসীর কাছে ঐতিহ্য বহন করে।

আধুনিক ঢাকায় মুঘলাই পরোটা

আজকের ঢাকায় মুঘলাই পরোটা শুধু পুরান ঢাকার খাবার নয়; এটি সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে ছোট্ট টঙের দোকানেও মুঘলাই পরোটা জনপ্রিয়। অনেক জায়গায় ভেতরে মুরগি, গরুর কিমা বা সবজি দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদে বানানো হয়। তবে ঢাকার ঐতিহ্য বহনকারী আসল মুঘলাই পরোটা হলো ডিম ও মাংস মিশিয়ে ঘি-তেলে ভাজা বড় আকারের পরোটা।

মুঘলাই পরোটা তৈরির পদ্ধতি

ঐতিহ্যবাহী ঢাকার মুঘলাই পরোটা বানানোর জন্য প্রয়োজন হয় সহজ উপকরণ ও বিশেষ কৌশল।

উপকরণ:

  • ময়দা ২ কাপ
  • ডিম ২–৩টি
  • গরু/মুরগির কিমা আধা কাপ
  • পেঁয়াজ কুচি ২ টেবিল চামচ
  • কাঁচা মরিচ কুচি ১ টেবিল চামচ
  • ধনেপাতা কুচি ১ টেবিল চামচ
  • আদা-রসুন বাটা আধা চা চামচ
  • লবণ স্বাদমতো
  • তেল বা ঘি ভাজার জন্য

প্রস্তুত প্রণালি:
প্রথমে ময়দায় লবণ ও সামান্য তেল মিশিয়ে নরম খামির তৈরি করতে হবে এবং ২০ মিনিট ঢেকে রাখতে হবে।
আলাদা পাত্রে ডিম ফেটে তার সঙ্গে কিমা, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা ও আদা-রসুন বাটা মিশিয়ে পুর তৈরি করতে হবে।
খামির থেকে বড় আকারে পাতলা রুটি বেলে নিতে হবে।
রুটির মাঝখানে পুর ঢেলে চারপাশ ভাঁজ করে চতুর্ভুজ আকারে মুড়িয়ে নিতে হবে।
কড়াইয়ে পর্যাপ্ত তেল বা ঘি গরম করে কম আঁচে দু’পাশ সোনালি করে ভাজতে হবে।
কেটে কেটে গরম গরম পরিবেশন করতে হবে, সাথে কাঁচা সালাদ বা সস দিলে স্বাদ বেড়ে যায়।

 সংক্ষেপে বলা যায়, দিল্লি-আগ্রার মুঘল দরবার থেকে জন্ম নেওয়া এই খাবার নবাবি ঢাকায় প্রবেশ করে এবং কয়েক শতকের ব্যবধানে এটি ঢাকাবাসীর নিত্যপ্রিয় নাস্তা ও রাতের খাবারের অংশে পরিণত হয়েছে।

জনপ্রিয় সংবাদ

বেতনা নদী: সাতক্ষীরা, খুলনার একটি ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক রত্ন

মুঘলাই পরোটা কীভাবে ঢাকায় এলো

১১:০০:৪১ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৫ অগাস্ট ২০২৫

মুঘলাই পরোটা মূলত মুঘল দরবারের খাবার সংস্কৃতি থেকে এসেছে। ১৬শ শতাব্দী থেকে মুঘল সম্রাটরা দিল্লি, আগ্রা ও পরে বাংলায় নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করেন। মুঘল রান্নাঘরে মাংস, ঘি, দুধ, বাদাম, ডিম ইত্যাদি ব্যবহার করে ভারী ও সমৃদ্ধ খাবারের প্রচলন তৈরি হয়। এই ধারায় “ভরাট পরোটা” বা মাংস-ডিম দিয়ে ভাজা পরোটা প্রথম প্রচলিত হয়।

বাংলায় আগমন

১৭শ শতকের শুরুতে বাংলায় মুঘল সুবেদার ইসলাম খান চিশতি রাজধানী ঢাকায় স্থাপন করেন (১৬১০ খ্রিস্টাব্দে)। এরপর থেকেই মুঘল প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে ঢাকায় বহু উত্তর ভারতীয় বাবুর্চি ও খাওয়াদাওয়ার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। তাদের হাতেই মুঘলাই রান্নার নানা রকম রেসিপি ঢাকায় প্রবেশ করে। মুঘলাই পরোটা সেই সময় থেকেই ঢাকার বাজার ও নবাবদের খাবার টেবিলে জায়গা করে নেয়।

নবাবি দরবার ও ঢাকার খাবার সংস্কৃতি

১৮শ ও ১৯শ শতকে ঢাকার নবাবি পরিবারগুলো, বিশেষত নবাব সলিমুল্লাহর আমলে, দিল্লি ও লখনৌর বাবুর্চিদের ঢাকায় আনেন। এই বাবুর্চিরা কাবাব, বিরিয়ানি, কোরমা ও মুঘলাই পরোটাকে বিশেষ জনপ্রিয় করে তোলেন। মাংস বা কিমা দিয়ে ভরা ডিম-লেপা এই পরোটা নবাবি ভোজসভায় মর্যাদার সঙ্গে পরিবেশিত হতো।

সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয়তা

প্রথমে মুঘলাই পরোটা নবাবি ও অভিজাত শ্রেণির খাবার হলেও ১৯শ শতকের শেষ দিকে এবং ২০শ শতকের শুরুতে এটি ঢাকার রাস্তাঘাট ও বাজারে বিক্রি হতে শুরু করে। পুরান ঢাকার দোকানগুলোতে ডিম ও কিমা দিয়ে তৈরি বড় মাপের ভাজা পরোটা ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের প্রিয় নাস্তা হয়ে ওঠে। স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী, অফিসপাড়া, এমনকি হাটে-ঘাটের মানুষও দ্রুত এটি গ্রহণ করে।

পুরান ঢাকার দোকান ও এলাকার ঐতিহ্য

ঢাকায় মুঘলাই পরোটার জনপ্রিয়তার সঙ্গে সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু এলাকা বিখ্যাত হয়ে ওঠে। পুরান ঢাকার নাজিরাবাজার, চকবাজার, আজিমপুর, চানখারপুল ও বাংলাবাজারের দোকানগুলো দীর্ঘদিন ধরে মুঘলাই পরোটা পরিবেশন করে আসছে। বিশেষ করে রাতের বেলায় চকবাজারে রমজানের ইফতারের সময় এই খাবারের ব্যাপক চাহিদা দেখা যায়। অনেক পুরনো দোকান দাবি করে, নবাবি আমলের বাবুর্চিদের হাত ধরেই তারা এই রেসিপি পেয়েছিল। তাই আজও পুরান ঢাকার মুঘলাই পরোটা ঢাকাবাসীর কাছে ঐতিহ্য বহন করে।

আধুনিক ঢাকায় মুঘলাই পরোটা

আজকের ঢাকায় মুঘলাই পরোটা শুধু পুরান ঢাকার খাবার নয়; এটি সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। রেস্তোরাঁ থেকে শুরু করে ছোট্ট টঙের দোকানেও মুঘলাই পরোটা জনপ্রিয়। অনেক জায়গায় ভেতরে মুরগি, গরুর কিমা বা সবজি দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদে বানানো হয়। তবে ঢাকার ঐতিহ্য বহনকারী আসল মুঘলাই পরোটা হলো ডিম ও মাংস মিশিয়ে ঘি-তেলে ভাজা বড় আকারের পরোটা।

মুঘলাই পরোটা তৈরির পদ্ধতি

ঐতিহ্যবাহী ঢাকার মুঘলাই পরোটা বানানোর জন্য প্রয়োজন হয় সহজ উপকরণ ও বিশেষ কৌশল।

উপকরণ:

  • ময়দা ২ কাপ
  • ডিম ২–৩টি
  • গরু/মুরগির কিমা আধা কাপ
  • পেঁয়াজ কুচি ২ টেবিল চামচ
  • কাঁচা মরিচ কুচি ১ টেবিল চামচ
  • ধনেপাতা কুচি ১ টেবিল চামচ
  • আদা-রসুন বাটা আধা চা চামচ
  • লবণ স্বাদমতো
  • তেল বা ঘি ভাজার জন্য

প্রস্তুত প্রণালি:
প্রথমে ময়দায় লবণ ও সামান্য তেল মিশিয়ে নরম খামির তৈরি করতে হবে এবং ২০ মিনিট ঢেকে রাখতে হবে।
আলাদা পাত্রে ডিম ফেটে তার সঙ্গে কিমা, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ, ধনেপাতা ও আদা-রসুন বাটা মিশিয়ে পুর তৈরি করতে হবে।
খামির থেকে বড় আকারে পাতলা রুটি বেলে নিতে হবে।
রুটির মাঝখানে পুর ঢেলে চারপাশ ভাঁজ করে চতুর্ভুজ আকারে মুড়িয়ে নিতে হবে।
কড়াইয়ে পর্যাপ্ত তেল বা ঘি গরম করে কম আঁচে দু’পাশ সোনালি করে ভাজতে হবে।
কেটে কেটে গরম গরম পরিবেশন করতে হবে, সাথে কাঁচা সালাদ বা সস দিলে স্বাদ বেড়ে যায়।

 সংক্ষেপে বলা যায়, দিল্লি-আগ্রার মুঘল দরবার থেকে জন্ম নেওয়া এই খাবার নবাবি ঢাকায় প্রবেশ করে এবং কয়েক শতকের ব্যবধানে এটি ঢাকাবাসীর নিত্যপ্রিয় নাস্তা ও রাতের খাবারের অংশে পরিণত হয়েছে।