আমদানির পরও কেন দাম কমছে না
বাংলাদেশ নিয়মিতভাবে ভারত থেকে পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচ আমদানি করে। সীমান্ত ঘেঁষা হাটগুলোতে প্রতিদিন ট্রাকে করে এসব পণ্য আসে। সরকার বলছে, আমদানির মাধ্যমে সরবরাহের ঘাটতি মেটানো সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন—ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা মফস্বলের খুচরা বাজারে দাম এত বেশি যে তা মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের সাধ্যের বাইরে চলে গেছে।
সরবরাহ শৃঙ্খলের অস্বচ্ছতা
আমদানি থেকে পাইকারি, এরপর খুচরা—এই সরবরাহ শৃঙ্খলে একাধিক ধাপে দাম বাড়ে। সীমান্ত থেকে ঢাকায় পৌঁছানোর আগেই পরিবহন খরচ, অযৌক্তিক মুনাফা এবং দালালদের প্রভাব যুক্ত হয়। ফলে খুচরা বাজারে ভোক্তাদের হাতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দাম দ্বিগুণ কিংবা তারও বেশি হয়ে যায়।
সিন্ডিকেট ও মজুদদারি
বাংলাদেশের ভোগ্যপণ্য বাজারে “সিন্ডিকেট” নতুন কিছু নয়। কিছু বড় ব্যবসায়ী ও পাইকারি আড়তদার একসাথে মজুদ তৈরি করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেন। এর ফলে বাজারে সরবরাহ থাকলেও খুচরা দামে আগুন ধরে। পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচ—দুই ক্ষেত্রেই এই চক্র সক্রিয়। আমদানির ঘোষণার পরও দাম না কমার মূল কারণ হলো এ ধরনের বাজারকেন্দ্রিক মনোপলি।

নীতি ও তদারকির দুর্বলতা
সরকার একদিকে শুল্ক কমিয়ে আমদানি সহজ করছে, অন্যদিকে মাঠপর্যায়ে তদারকি কার্যকর হচ্ছে না। আমদানিকারকরা সুযোগ নিচ্ছেন, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা নির্দ্বিধায় অতিরিক্ত দাম নিচ্ছেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযান সীমিত ও বিচ্ছিন্ন হওয়ায় বাজার নিয়ন্ত্রণের কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
পরিবহন ব্যয় ও অবকাঠামো সংকট
সীমান্ত থেকে রাজধানী বা বড় শহরে পণ্য আনতে পরিবহন ব্যয় ক্রমশ বাড়ছে। ডিজেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি, ট্রাক ভাড়া, মহাসড়কের চাঁদাবাজি—সব মিলিয়ে খরচ বেড়ে যায়। এই বাড়তি খরচও খুচরা দামে যুক্ত হয়, ফলে বাজারে চাপ তৈরি হয়।
ভোক্তাদের ওপর প্রভাব
মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো প্রতিদিনের রান্নায় পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচ ছাড়া উপায় পায় না। কিন্তু অতিরিক্ত দামের কারণে অনেক পরিবার এখন কম ব্যবহার করছে বা বিকল্প খুঁজছে। নিম্নআয়ের মানুষের অবস্থা আরও কঠিন—তাদের খাদ্যতালিকা থেকে প্রায়ই বাদ পড়ছে এই মৌলিক উপাদানগুলো। এতে পুষ্টি ও স্বাদের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে, পাশাপাশি বাড়ছে সামাজিক ক্ষোভ।

সমাধানের পথ
১. সিন্ডিকেট ভাঙা: বড় আড়তদারদের একচেটিয়া ক্ষমতা কমাতে নিয়মিত তদারকি ও কঠোর শাস্তি প্রয়োজন।
২. আমদানি ও বিতরণ স্বচ্ছতা: আমদানির পর কত পণ্য কোথায় যাচ্ছে তা অনলাইন ট্র্যাকিংয়ের আওতায় আনা জরুরি।
৩. রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ: টিসিবির মাধ্যমে সুলভমূল্যে পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচ সরবরাহ বাড়াতে হবে।
৪. পরিবহন ব্যয় কমানো: মহাসড়কে চাঁদাবাজি বন্ধ, জ্বালানি ভর্তুকি ও রেলপথ ব্যবহার করে ব্যয় কমানো সম্ভব।
অতিরিক্ত বিশ্লেষণ ও উদাহরণ
ঢাকার কারওয়ান বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভারত থেকে আমদানি করা প্রতি কেজি পেঁয়াজ সীমান্তে গড়ে ৩০ টাকা দরে ঢোকে। কিন্তু রাজধানীতে এসে সেটির দাম দাঁড়ায় ৭০ থেকে ৮০ টাকা। পাইকারি ও খুচরা—দুই ধাপে লাভজনক মুনাফা যোগ হওয়ার ফলে এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ঘটে। একইভাবে, সীমান্তে ১৫০ টাকা কেজি দরে আমদানিকৃত কাঁচামরিচ ঢাকায় এসে বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকার ওপরে।
গাজীপুরের এক গৃহিণী জানালেন, আগে প্রতিদিন রান্নায় অর্ধেক কেজি পেঁয়াজ ব্যবহার করলেও এখন বাধ্য হয়ে তিন ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছেন। কাঁচামরিচও তিনি কিনছেন আগের অর্ধেক পরিমাণে। ফলে রান্নার স্বাদ যেমন কমছে, তেমনি পরিবারে খাবারের বৈচিত্র্যও হারিয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞ মতামত
অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশে বাজারব্যবস্থার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো সরবরাহ শৃঙ্খলের স্বচ্ছতার অভাব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন বলেন:
“আমদানি সঠিকভাবে হলেও খুচরা বাজারে দাম বাড়বে, যদি রাষ্ট্র সরবরাহ শৃঙ্খলে নজরদারি করতে ব্যর্থ হয়। সিন্ডিকেট ভাঙতে না পারলে বাজার স্থিতিশীল হবে না।”

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ বা আসামের বাজারে পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচের দাম তুলনামূলক অনেক কম। সীমান্তের দুই পাড়ের দামের এই বিশাল ফারাক বাংলাদেশের ভোক্তাদের জন্য অযৌক্তিক বোঝা তৈরি করছে। প্রতিবেশী দেশের তুলনায় একই পণ্য তিন গুণ দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
সামাজিক প্রভাব
সামাজিক সংগঠনগুলোর মতে, পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচ শুধু রান্নার উপকরণ নয়, এটি বাংলাদেশিদের সংস্কৃতি ও খাদ্যাভ্যাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এ ধরনের নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্য মানে হলো—মধ্যবিত্ত ও দরিদ্র মানুষের জীবনে প্রতিদিনের কষ্ট আরও বাড়ানো।
উপসংহার
ভারত থেকে নিয়মিত আমদানি হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশে পেঁয়াজ ও কাঁচামরিচের খুচরা দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে মূলত অস্বচ্ছ বাজারব্যবস্থা, সিন্ডিকেট, পরিবহন ব্যয় এবং তদারকির দুর্বলতার কারণে। সমাধানের জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, কার্যকর বাজার তদারকি এবং স্বচ্ছ সরবরাহ ব্যবস্থা। অন্যথায় আমদানির ঘোষণা শুধু কাগজে থাকবে, কিন্তু বাজারে দাম বাড়তেই থাকবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















