বাংলা সাহিত্যে ‘জাতীয় মঙ্গল’-এর কবি হিসেবে খ্যাত মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক ছিলেন উনিশ ও বিশ শতকের সন্ধিক্ষণে মুসলিম নবজাগরণের অন্যতম কণ্ঠস্বর। তাঁর কাব্যে মানবিকতা, সমাজসংস্কার ও দেশাত্মবোধের অনুরণন যেমন প্রবল, তেমনি সংগঠক, সম্পাদক ও রাজনীতিবিদ হিসেবেও তাঁর ভূমিকা উজ্জ্বল। তিনি পরবর্তীতে বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইন পরিষদের চিফ হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
জন্ম, পরিবার ও শৈশব
মোজাম্মেল হক ৬ সেপ্টেম্বর ১৮৮৩ বা ১৮৮৫ সালে বরিশালের ভোলায় এক সম্মানিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মুন্সী আবদুল করিম। শৈশবে তিনি ভোলার বাপ্তা গ্রামের নানাবাড়িতে বড় হন। পরিবারের সামাজিক মর্যাদা ও পাণ্ডিত্যপ্রীতি তাঁর বেড়ে ওঠার ভিত গড়ে দেয়।
শিক্ষাজীবন
প্রবেশিকা পাশ করেন কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশন থেকে। পরে প্রেসিডেন্সি কলেজে আইএ ও স্নাতক সম্পন্ন করে আইনশাস্ত্রে পড়াশোনা করেন। ছাত্রাবস্থায়ই মুসলিম সমাজের পশ্চাৎপদতা দূরীকরণে তিনি সংকল্পবদ্ধ হন, যা পরবর্তীতে তাঁকে সাহিত্যচর্চা, সংগঠন ও জনসেবার পথে নিয়ে আসে।
সম্পাদক, সংগঠক ও ‘মোসলেম ভারত’
মোজাম্মেল হক ছিলেন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির প্রধান সংগঠকদের একজন। তিনি সমিতির মুখপত্র বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করেন। এখান থেকেই বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রাথমিক রচনা প্রকাশিত হয়। তাঁর হাত ধরেই বহু নবীন প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। এছাড়া তিনি মোসলেম ভারত-সহ একাধিক সাময়িকীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন।
সাহিত্যজীবন: ‘জাতীয় মঙ্গল’ থেকে জীবনী-গদ্য
১৯০৯ সালে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ জাতীয় মঙ্গল তাঁকে ব্যাপক খ্যাতি এনে দেয়। এই গ্রন্থের নাম থেকেই তিনি ‘জাতীয় মঙ্গল’-এর কবি হিসেবে পরিচিত হন। তাঁর কবিতায় সমাজসংস্কার, মানবমুক্তি, প্রকৃতিপ্রেম, ন্যায়বিচার ও ধর্মীয় গোঁড়ামিমুক্ত আধ্যাত্মিকতার সুর প্রবলভাবে ধ্বনিত হয়েছে।
গদ্য সাহিত্যে তিনি জীবনী ও ইতিহাসভিত্তিক রচনায় পারদর্শিতা দেখান। তাঁর লেখা ফেরদৌসি চরিত, মহর্ষি মনসুর, হাতেমতাই, টিপু সুলতান ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পায়। দরফ গাজি খান ছিল উল্লেখযোগ্য উপন্যাস।
কবিতার মূল থিম
- মানবমুক্তি, ন্যায়বিচার ও সাম্যচেতনা
- প্রান্তিক মানুষের স্বপ্ন ও সংগ্রাম
- প্রকৃতিপ্রেম, দেশাত্মবোধ ও আধ্যাত্মিক অন্বেষা
এসবই তাঁর কবিতাকে সমাজ-উন্নয়নমুখী ধারায় প্রতিষ্ঠিত করেছে।

জনকল্যাণ, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক কাজ
ভোলা-বাকেরগঞ্জ অঞ্চলসহ কলকাতায় তিনি শিক্ষাবিস্তার ও সংগঠন গঠনে সক্রিয় ছিলেন। তাঁর একক উদ্যোগে ভোলা ও আশপাশের এলাকায় দশটির বেশি উচ্চবিদ্যালয় ও কয়েকটি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। শিক্ষা-উন্নয়ন ও সামাজিক সংগঠন নির্মাণে তাঁর এই কাজ তাঁকে ব্যাপক জনপ্রিয় করে তোলে।
সংসদীয় জীবন: দল, আসন ও দায়িত্ব
১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কৃষক প্রজা পার্টির মনোনয়নে মোজাম্মেল হক বঙ্গীয় প্রাদেশিক আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তিনি চিফ হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কৃষক-প্রজা স্বার্থ রক্ষা, শিক্ষাবিস্তার এবং প্রশাসনে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় তিনি সক্রিয় ভূমিকা রাখেন।
- দলীয় পরিচয়: এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে গঠিত কৃষক প্রজা পার্টি ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে প্রাদেশিক রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
- রাজনৈতিক ঘাঁটি: ভোলা-বাকেরগঞ্জ অঞ্চল ও কলকাতা-কেন্দ্রিক সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড।
- সংসদীয় কার্যক্রম: বাংলা ভাষায় বক্তব্য দিয়ে আইনসভায় মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এবং কৃষক-প্রজা স্বার্থে সক্রিয় অংশগ্রহণ।
‘জাতীয় মঙ্গল কবি’ স্বীকৃতি ও সমকালীনরা
মানবতাবাদী চেতনা ও সমাজমুখী কাব্যের কারণে সমকালেই তিনি ‘জাতীয় মঙ্গল কবি’ অভিধায় সম্বোধিত হন। একদিকে কবি-সম্পাদক-সংগঠক, অন্যদিকে সংসদীয় রাজনীতিবিদ হিসেবে তিনি জনসেবার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখেন। নজরুলসহ সমসাময়িক সাহিত্যধারার বিকাশে তাঁর প্ল্যাটফর্ম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
উত্তরজীবন ও মৃত্যু
দীর্ঘ সাংগঠনিক ও সাহিত্যকর্ম শেষে ১ আগস্ট ১৯৭৬ সালে মোজাম্মেল হক মৃত্যুবরণ করেন। সমকালীন স্মৃতিচারণ ও আঞ্চলিক ইতিহাসে তাঁর শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান নির্মাণ, সম্পাদকীয় কাজ ও রাজনৈতিক ভূমিকা বিশেষভাবে স্বীকৃত হয়েছে।
সারাংশ
- জন্ম: ভোলা, সম্মানিত পরিবারে, ১৮৮৩/১৮৮৫
- শিক্ষা: মিত্র ইনস্টিটিউশন, প্রেসিডেন্সি কলেজ, আইনশাস্ত্র অধ্যয়ন
- সম্পাদনা: বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা, মোসলেম ভারত
- গ্রন্থ: জাতীয় মঙ্গল (১৯০৯), জোহরা, দরফ গাজি খান, জীবনী ও ইতিহাসভিত্তিক বহু রচনা
- রাজনীতি: কৃষক প্রজা পার্টি, ১৯৩৭–৪৫ চিফ হুইপ, প্রাদেশিক আইন পরিষদ
- জনকল্যাণ: ভোলা অঞ্চলে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















