বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সাশ্রয়ী প্রোটিনের প্রধান উৎস ছিল মুরগি। আগে যেখানে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের পরিবারগুলো সহজেই সপ্তাহে একাধিকবার মুরগি কিনতে পারত, এখন অনেকের রান্নাঘরে এটি এক ধরনের বিলাসে পরিণত হয়েছে। বাজারে গিয়ে দেখা যায়, ব্রয়লার থেকে শুরু করে সোনালী কিংবা দেশি—সব ধরনের মুরগির দাম ক্রমেই বাড়ছে। এই অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতির পেছনে রয়েছে একাধিক জটিল কারণ।
উৎপাদন ব্যয়ের চাপ
খামারিদের অভিযোগ, উৎপাদন খরচ বিগত এক বছরে কমপক্ষে ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়েছে। মুরগির খাদ্যের প্রধান উপাদান ভুট্টা, সয়াবিন, মাছের গুঁড়া ও ভিটামিন প্রায় সবই আমদানিনির্ভর। আন্তর্জাতিক বাজারে এসব উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় খামারিদের জন্য মুরগি পালন আগের মতো সাশ্রয়ী থাকছে না।
ময়মনসিংহের এক খামারি বলেন,
“আগে প্রতিটি ব্রয়লার মুরগি বড় করতে যে খরচ হতো, এখন তার চেয়ে অন্তত ৩০ টাকা বেশি খরচ হচ্ছে। সেই অতিরিক্ত খরচ শেষ পর্যন্ত আমাদেরই বহন করতে হচ্ছে।”

ডলার সংকট ও আমদানি ব্যয়
দেশে চলমান ডলার সংকট মুরগির বাজারকে অস্থির করে তুলেছে। খাদ্য উপাদান আমদানির জন্য ডলার সহজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে যারা আমদানি করতে পারছেন, তাদেরও বেশি দামে তা কিনতে হচ্ছে। ব্যাংক ও আমদানিকারকদের এই অতিরিক্ত ব্যয় শেষ পর্যন্ত খামারিদের উপর পড়ছে।
পরিবহন ও জ্বালানি খরচ
গ্রামাঞ্চল থেকে শহরে মুরগি পৌঁছাতে পরিবহনের খরচ এখন দ্বিগুণ। ডিজেল, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়ায় পুরো সরবরাহ শৃঙ্খলে অতিরিক্ত চাপ পড়েছে। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে অনেক খামারে ব্রুডার বা ফিড মেশিন নিয়মিত চালানো যাচ্ছে না।
ঢাকার এক খুচরা ব্যবসায়ী জানান,
“আমরা পাইকারি বাজার থেকে যেই দামে মুরগি কিনে আনি, খরচ হিসাব করলে নগরবাসীর কাছে কম দামে বিক্রি করা একেবারেই অসম্ভব।”

রোগবালাই ও উৎপাদন ঝুঁকি
মুরগির খামার সবসময় রোগবালাইয়ের ঝুঁকিতে থাকে। হঠাৎ কোনো ভাইরাস দেখা দিলে খামারিরা বড় ক্ষতির মুখে পড়েন। এ কারণে অনেকেই এখন আর আগের মতো ঝুঁকি নিয়ে বেশি সংখ্যায় মুরগি পালন করতে চান না। ছোট ও মাঝারি খামারিরা বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। এর ফলেই বাজারে সরবরাহ কমে যাচ্ছে, আর দাম বাড়ছে।
ভোক্তার উপর প্রভাব
সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। আগে ব্রয়লারকে বলা হতো ‘গরিবের প্রোটিন’। এখন সেটাও নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সোনালী বা দেশি মুরগির কথা তো বলাই বাহুল্য, অনেক পরিবার মাসে একবারও কিনতে পারছে না।
রাজধানীর এক গৃহিণী বলেন,
“আগে সপ্তাহে দুই দিন মুরগি রান্না করতাম। এখন মাসে একবার কিনতে পারলেই ভাগ্য। দাম এত বেশি যে বাজেট সামলানো কঠিন হয়ে গেছে।”

বাজারে ভিন্ন ভিন্ন ধাক্কা
ব্রয়লার: সবচেয়ে সহজলভ্য হলেও উৎপাদন খরচের কারণে দাম বেড়েছে।
সোনালী: হাইব্রিড জাত হওয়ায় দাম তুলনামূলক বেশি, তবে চাহিদা একই থাকায় বাজারে চাপ তৈরি হয়েছে।
দেশি: সীমিত পরিসরে খামারে পালিত হয়, সরবরাহ খুব কম। তাই দামের ঊর্ধ্বগতি আরও তীব্র।
নীতি সহায়তার অভাব
বাংলাদেশে এখনো পোলট্রি খাত বড় পরিসরে সরকারিভাবে সহায়তা পায় না। খাদ্য ভর্তুকি, সহজ ঋণ কিংবা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকলে খামারিরা স্থিতিশীলভাবে ব্যবসা চালাতে পারতেন। অথচ এখন খামারিরা ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়ে মুরগি পালন করছেন। ফলে সামান্য ধাক্কাতেই বাজারে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক প্রভাব
শুধু দেশীয় কারণ নয়, আন্তর্জাতিক বাজারের টানাপোড়েনও ভূমিকা রাখছে। ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে ভুট্টা ও গমের দাম বেড়েছে, যা মুরগির খাদ্যের মূল উপকরণ। আবার বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে অস্থিরতা পরিবহন ব্যয় আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
সামনে কী হতে পারে
বিশেষজ্ঞদের মতে, খাদ্যে ভর্তুকি, খামারিদের জন্য সহজ ঋণ সুবিধা, আমদানিতে স্থিতিশীল ডলার সরবরাহ এবং পরিবহন খরচ নিয়ন্ত্রণ—এই চারটি পদক্ষেপ নিলে বাজার কিছুটা স্থিতিশীল হতে পারে। তবে আন্তর্জাতিক বাজার স্বাভাবিক না হলে নিকট ভবিষ্যতে মুরগির দামে বড় কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা নেই।
মুরগি বাংলাদেশের মানুষের খাদ্য সংস্কৃতির অপরিহার্য অংশ। একে বলা হয়েছিল সহজলভ্য প্রোটিনের উৎস। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সেই ধারণা বদলে দিচ্ছে। উৎপাদন ব্যয়, আমদানি নির্ভরতা, পরিবহন খরচ ও নীতিগত সীমাবদ্ধতার কারণে মুরগির দাম ক্রমেই ঊর্ধ্বমুখী। সমাধান খুঁজে না পেলে এটি নিম্ন ও মধ্যবিত্তের জন্য আরও বড় বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 


















