কঠিন দরকষাকষির মুখে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা
বেঙ্গালুরু — দক্ষিণ ভারতের করুর শহরে টেক্সটাইল পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সারথি এক্সপোর্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সুকুমার সুব্রমানিয়াম প্রস্তুতি নিচ্ছেন কঠিন দরকষাকষির জন্য।
ঘোষণা অনুযায়ী বুধবার থেকে ৫০% মার্কিন আমদানি শুল্ক কার্যকর হওয়ার কথা। এর পরপরই খুচরা বিক্রেতা ডলার জেনারেল তাকে ১৬% দাম কমানোর অনুরোধ করেছে। শিগগিরই আরও মার্কিন ক্রেতারা একই দাবি তুলবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিন্তু সুব্রমানিয়াম জানিয়ে দিয়েছেন, এত বড় ছাড় দেওয়া একেবারেই “অসম্ভব”। সর্বোচ্চ ৩% পর্যন্ত দেওয়া যেতে পারে।
রাশিয়ান তেল কেনায় শাস্তিমূলক কর
সুব্রমানিয়ামসহ হাজার হাজার ভারতীয় উৎপাদক এখন ওয়াশিংটনের আরোপিত “প্রতিশোধমূলক শুল্কের” ধাক্কা সামলানোর চেষ্টা করছেন। ভারতীয় রপ্তানি পণ্যে আগে থেকেই ২৫% কর ছিল। এবার রাশিয়া থেকে বিপুল তেল কেনার কারণে ৫০% কর আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিযোগ, ভারত রাশিয়ার “যুদ্ধযন্ত্রকে জ্বালানি” জোগাচ্ছে।
প্রতিযোগিতা হারাচ্ছে ভারতীয় পণ্য
এই বাড়তি করের কারণে মার্কিন বাজারে ভারতীয় পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। ফলে ক্রেতারা ছাড় চাইছেন এবং রপ্তানিকারকরা পড়েছেন দোটানায়। ছাড় দিলে মুনাফা কমে যাবে, ছাড় না দিলে বিশ্বের বৃহত্তম বাজার হারানোর ঝুঁকি আছে।
সুব্রমানিয়াম জানিয়েছেন, তার মোট বিক্রির প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। যদি ৫০% কর বহাল থাকে তবে অর্ডার “অত্যন্ত কমে যাবে”। কারণ তার টেবিল-লিনেন, রান্নাঘরের সামগ্রী, টোট ব্যাগ ও হোম ফার্নিশিংস ভিয়েতনাম বা চীন থেকে অনেক কম দামে কেনা সম্ভব। বর্তমানে ভিয়েতনামের পণ্যে ২০% আর চীনা পণ্যে ৩০% শুল্ক আছে, যদিও ১০ নভেম্বর থেকে চীনা পণ্যে ৫০% এর বেশি কর বসবে।
অক্সফোর্ড ইকোনমিক্সের প্রধান অর্থনীতিবিদ আলেকজান্দ্রা হারম্যান বলেন, “২৫% করের মধ্যে মার্জিন কমিয়ে বা দক্ষতা বাড়িয়ে ভারতীয় উৎপাদকরা প্রতিযোগিতায় থাকতে পারতো। কিন্তু ৫০% করের মধ্যে সেটা কার্যত অসম্ভব।”
চাকরি খাতে বিপদের আশঙ্কা
ওয়াশিংটন আপাতত পেট্রোলিয়াম, ওষুধ ও স্মার্টফোন খাতকে ছাড় দিয়েছে। তবে বাকি খাতগুলো, যা গত অর্থবছরে ভারতের মোট ৮৬.৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির ৭২% জুড়ে ছিল, সেখানে অর্ডার ৯০% পর্যন্ত কমতে পারে বলে জানিয়েছে নয়াদিল্লিভিত্তিক থিংক ট্যাঙ্ক গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভ (GTRI)।
জিটিআরআই-এর প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, “শ্রমনির্ভর খাত যেমন টেক্সটাইল, পোশাক, সীফুড ও গহনা অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে। দুই দশকে গড়ে ওঠা বাজার দ্রুত হাতছাড়া হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। এর ফলে কর্মসংস্থানে ভয়াবহ প্রভাব পড়বে।”
বিকল্প বাজারে চরম প্রতিযোগিতা
যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি কমে যাওয়ার আশঙ্কায় ভারতীয় রপ্তানিকারকরা নতুন বাজার খুঁজছেন। সুব্রমানিয়াম জানিয়েছেন, তিনি ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা ও আফ্রিকায় বিক্রি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এসব বাজারে প্রবেশ সহজ নয়।
শ্রীবাস্তব বলেন, “বেশিরভাগ দেশেই ১৫% থেকে ২০% শুল্ক লাগু আছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রে দাম বাড়লে আমেরিকান চাহিদা আরও কমে যাবে। এতে বিশ্বব্যাপী রপ্তানিকারকরা বিকল্প বাজারে অতিরিক্ত পণ্য চাপিয়ে দিতে ঝাঁপাবে, আর প্রতিযোগিতা হবে ভয়ঙ্কর।”
আলোচনায় অচলাবস্থা
বিশ্লেষকরা আশা করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত বাণিজ্য চুক্তি হলে বাড়তি শুল্ক তুলে নেওয়া হতে পারে। কিন্তু আলোচনায় গতি নেই। বরং দুই দেশের অচলাবস্থা আরও গভীর হয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, কৃষকের স্বার্থে ভারত কোনো আপস করবে না, যদিও এজন্য তাকে “ব্যক্তিগতভাবে বড় মাশুল” দিতে হয়।
ভারত কৃষি ও দুগ্ধ খাত মার্কিন আমদানির জন্য খুলে দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ফলে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় অগ্রগতি নেই। এতে ভারতের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ধাক্কা লাগবে বলে আশঙ্কা করছে নোমুরা। তাদের হিসাবে চলতি অর্থবছরের ৬.২% প্রবৃদ্ধি থেকে ০.২ শতাংশ কমে যেতে পারে।
মার্কিন মাটিতে উৎপাদনের চিন্তা
আলোচনা স্থবির হয়ে পড়ায় কিছু প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্রের ভেতরেই উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে, যদিও সেখানে খরচ অনেক বেশি।
মুম্বাইয়ের কামা জুয়েলারি-র ব্যবস্থাপনা পরিচালক কলিন শাহ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র তাদের জন্য একটি “গুরুত্বপূর্ণ” বাজার। বছরে ৩০ মিলিয়ন ডলারের বিক্রি হয় সেখান থেকে, যা মোট রপ্তানির প্রায় অর্ধেক।
তিনি বলেন, “অনেক উৎপাদকের জন্য আমেরিকা ব্যবসার বড় অংশ। এটা সহজে প্রতিস্থাপন করা যায় না। শুল্ক যদি দীর্ঘস্থায়ী হয়, আমাদের যুক্তরাষ্ট্রেই উৎপাদন শুরু করতে হবে… যদিও ভারতের তুলনায় খরচ অনেক বেশি, কিন্তু আর কোনো উপায় নেই।”
সারাক্ষণ রিপোর্ট 






















