গরমকে কেন গুরুত্ব দিতে হবে
ইন্টারনেটে খোঁজ করলে গর্ভাবস্থায় কী কী এড়িয়ে চলা উচিত—এমন অসংখ্য পরামর্শ পাওয়া যায়। যৌনসম্পর্ক, ঝাল খাবার, সাঁতার বা সানস্ক্রিন ব্যবহার—এসবকে অনেকেই নিষিদ্ধ তালিকায় ফেললেও বাস্তবে এগুলো ক্ষতিকর নয়। তবে ধূমপান, অ্যালকোহল এবং পারদসমৃদ্ধ সামুদ্রিক মাছ সত্যিকার অর্থেই বিপজ্জনক। এই তালিকায় গরমকেও অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
অতিরিক্ত গরম যেকোনো মানুষের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু গর্ভাবস্থায় দ্রুত বিপাকক্রিয়া, বেশি তাপ উৎপাদন ও হৃদ্যন্ত্রের ওপর চাপ বৃদ্ধির কারণে নারীরা বিশেষভাবে ঝুঁকিতে থাকেন। এতে মা ও শিশুর জন্য নানা ভয়াবহ পরিণতি দেখা দিতে পারে। একসময় বিশ্বজুড়ে মাতৃ ও নবজাতক স্বাস্থ্য ছিল বড় অগ্রাধিকার। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তা কিছুটা থেমে গেছে, আংশিকভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের দিকে নজর দেওয়ার কারণে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, দুই সমস্যাই ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।
বৈজ্ঞানিক প্রমাণ
বিশ্বজুড়ে হওয়া গবেষণায় স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে, তাপমাত্রা বাড়লে নারীদের ৩৭ সপ্তাহের আগেই সন্তান জন্ম দেওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। ৬৬টি দেশের ১৯৮টি গবেষণা একত্র করে করা এক সাম্প্রতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, গর্ভধারণের শেষ মাসে প্রতি ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে অকালপ্রসবের ঝুঁকি ৪ শতাংশ বাড়ে। দীর্ঘ সময় গরম থাকলে ঝুঁকি আরও বেশি হয়।

যেখানে তাপপ্রবাহ দেখা দেয়—সে দেশ সুইডেন হোক বা সেনেগাল—সেখানকার গর্ভবতী নারীদের অকালপ্রসবের ঝুঁকি এক চতুর্থাংশের বেশি বেড়ে যায়। তবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হলো গরম ও দরিদ্র দেশগুলো। অকালপ্রসবজনিত জটিলতায় বিশ্বে মোট নবজাতক মৃত্যুর ৪০ শতাংশ ঘটে। বেঁচে যাওয়া শিশুরাও নানা প্রতিবন্ধকতা ও অসুস্থতায় ভোগে।
শুধু অকালপ্রসব নয়, অতিরিক্ত গরম মৃতশিশু জন্ম, কিছু জন্মগত ত্রুটি, গর্ভকালীন ডায়াবেটিস এবং প্রি-এক্ল্যাম্পশিয়ার সঙ্গেও যুক্ত। শেষোক্ত রোগটি মায়ের জীবনকেও ঝুঁকিতে ফেলে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপমাত্রা বাড়ছে এবং তীব্র গরমের ঘটনাও বাড়ছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্লাইমেট সেন্ট্রালের তথ্য অনুযায়ী, ২৪৭টি দেশের মধ্যে ২২২টিতেই গর্ভাবস্থার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ গরম দিনের সংখ্যা অন্তত দ্বিগুণ হয়েছে। কিছু দেশে নবজাতকের তাপজনিত মৃত্যুর এক-তৃতীয়াংশের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করা হচ্ছে। চীনে প্রতি বছর তাপপ্রবাহজনিত অকালপ্রসবের এক-চতুর্থাংশেরও বেশি এ কারণে ঘটছে। এমনকি যদি বিশ্ব কার্বন নিঃসরণ দ্রুত কমিয়েও ফেলে, তবুও ঝুঁকির প্রভাব আরও বাড়বে।
করণীয় কী?
প্রথম পদক্ষেপ হলো গর্ভবতী নারীদের ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করা, যাতে তারা সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে পারেন। তবে গরম কেন ক্ষতি করে—এর সঠিক প্রক্রিয়া এখনো স্পষ্ট নয়। তাই সাধারণ পরামর্শ দেওয়া হয়—শীতল থাকার চেষ্টা করা, পর্যাপ্ত পানি পান করা, গরম সময় বা তাপপ্রবাহ এড়িয়ে কাজ পরিকল্পনা করা, এবং তাপজনিত চাপের প্রথম লক্ষণেই চিকিৎসা নেওয়া।

তবে বাস্তবে দরিদ্র নারীরা এসব মেনে চলতে পারেন না। তাই বিশেষ সহায়তা দরকার। যুক্তরাষ্ট্রে কয়েকটি অঙ্গরাজ্য এখন দরিদ্রদের স্বাস্থ্যসেবা প্রোগ্রাম মেডিকেইডের আওতায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের খরচে সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু সব দরিদ্র গর্ভবতী নারীকে এ সুবিধা দেওয়া উচিত। তুলনামূলক কম উন্নত দেশে ঘরে ছাউনি বা শেড যোগ করাও তাপমাত্রা কমাতে সহায়ক। স্বাস্থ্যকর্মী ও তাপপ্রবাহ মোকাবিলাদায়ী কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া জরুরি।
গবেষণা ও নীতির গুরুত্ব
যখন নারীরা ঝুঁকি সম্পর্কে জানবেন, তখন তারা আরও তথ্য চাইবেন। এটি ইতিবাচক কারণ গবেষণা তহবিল বাড়বে এবং জানা যাবে গরম কীভাবে ও কেন গর্ভাবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। বড় পরিসরের গবেষণা এখন শুরু হয়েছে। এখনো অনেক অজানা রয়ে গেছে—কোন জৈবিক প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়, কিংবা গর্ভাবস্থার কোন পর্যায়ে ঝুঁকি সর্বাধিক।
এসব জানলে কার্যকর নীতি নির্ধারণ ও চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবন সম্ভব হবে। তাই সরকারগুলোর উচিত প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ শুরু করা। তবে সবচেয়ে জরুরি হলো—সমস্যাটিকে স্বীকার করা। সেটিই প্রথম পদক্ষেপ।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















