মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য দীর্ঘদিন ধরেই রোহিঙ্গা সংকটের কেন্দ্রবিন্দু। অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে রোহিঙ্গারা বৈষম্য, নিপীড়ন ও নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চনার শিকার। ২০১৭ সালে রাখাইন থেকে বাংলাদেশে প্রায় সাত লক্ষ রোহিঙ্গা পালিয়ে আসার পর আন্তর্জাতিক পরিসরে এ সংকট নতুন করে আলোচনায় আসে। আজ, ২০২৫ সালে আবারও রাখাইনের উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতি নতুন শরণার্থী ঢলের আশঙ্কা সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন উঠছে—বাংলাদেশ কি আরেক দফা রোহিঙ্গা ঢল সামলাতে পারবে?
জাতিসংঘের সতর্কবার্তা
জাতিসংঘ সম্প্রতি সতর্ক করেছে যে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গারা নতুন করে এক মারাত্মক ক্রসফায়ার পরিস্থিতিতে আটকে পড়েছে। আরাকান আর্মি (AA) ও মিয়ানমার সেনাদের সংঘর্ষের পাশাপাশি স্থানীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর আক্রমণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রোহিঙ্গারা। জাতিসংঘ জানায়, তারা প্রতিনিয়ত হামলা, লুটপাট ও হয়রানির শিকার হচ্ছে এবং নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
রোহিঙ্গাদের ইতিহাস ঘিরে রয়েছে দীর্ঘ বৈষম্য। ঔপনিবেশিক যুগে ব্রিটিশ শাসনের সময় ভারতীয় মুসলিম অভিবাসীদের রাখাইনে বসবাসের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীন মিয়ানমারের পরবর্তী সময়ে এই জনগোষ্ঠীকে বহিরাগত হিসেবে চিহ্নিত করা শুরু হয়।

১৯৮২ সালে সামরিক সরকার নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিক মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করে। তাদের রাষ্ট্রহীন করে দেওয়া হয়, জমি-সম্পত্তির অধিকার হরণ করা হয়, এবং শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে বৈষম্যের শিকার হতে হয়।
২০১২ সালে রাখাইনে বৌদ্ধ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের সংঘর্ষে ব্যাপক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। হাজার হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। ২০১৭ সালের অভিযানে মিয়ানমার সেনারা আগুন লাগানো, গণধর্ষণ ও নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালায়। জাতিসংঘ এটিকে “জাতিগত নিধনের পাঠ্যবই উদাহরণ” হিসেবে বর্ণনা করে। সেই সময় বাংলাদেশে প্রায় সাত লক্ষ রোহিঙ্গা আশ্রয় নেয়।
আরাকান আর্মির ভূমিকা
রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি বহু বছর ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে স্বাধীনতার দাবিতে লড়াই করছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে তাদের লক্ষ্যবস্তুতে রোহিঙ্গারাও যুক্ত হয়েছে। স্থানীয় সূত্র মতে, অনেক সময় রোহিঙ্গাদের ‘সেনার দোসর’ হিসেবে অভিযুক্ত করে আরাকান আর্মি প্রতিশোধমূলক হামলা চালায়। এতে রোহিঙ্গারা এক অচলাবস্থায় পড়েছে—সেনারা যেমন তাদের ওপর নির্যাতন চালাচ্ছে, তেমনি বিদ্রোহীরাও আক্রমণ করছে।
রোহিঙ্গা মিলিট্যান্টদের হুমকি
সম্প্রতি কিছু রোহিঙ্গা মিলিট্যান্ট গোষ্ঠী ভিডিও বার্তায় ঘোষণা দিয়েছে, তারা অস্ত্র হাতে নিয়ে আরাকান আর্মির বিরুদ্ধে লড়াই করবে। আন্তর্জাতিক পত্রিকা The Diplomat-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই পদক্ষেপ রাখাইনের পরিস্থিতিকে আরও অনিশ্চিত করে তুলছে। কারণ, রোহিঙ্গারা যদি সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে জড়ায়, তবে তারা শুধু ভুক্তভোগী নয়, সংঘর্ষের পক্ষেও পরিণত হবে। এতে করে মানবিক বিপর্যয় আরও গভীর হতে পারে।

সম্ভাব্য মানবিক বিপর্যয়
বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই প্রায় ১২ লক্ষ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে চরম চাপের মধ্যে রয়েছে। কক্সবাজার ও টেকনাফের শরণার্থী শিবিরগুলোতে জনসংখ্যার চাপ, পরিবেশগত ক্ষতি এবং সামাজিক দ্বন্দ্ব বাড়ছে। বর্তমান রাখাইন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে নতুন ঢলের আশঙ্কা প্রবল।
- • অর্থনৈতিক চাপ: সীমিত সম্পদে নতুন শরণার্থীদের খাবার, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা নিশ্চিত করা কঠিন হবে।
- • মানবিক সংকট: ক্যাম্পে অতিরিক্ত ভিড়, অনিরাপদ বসতি, স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অপরাধপ্রবণতা আরও বাড়বে।
- • কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ: আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতা ছাড়া বাংলাদেশ একা এই বোঝা বহন করতে পারবে না।
বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা ও আশঙ্কা
২০১৭ সালের ঢলে বাংলাদেশ দ্রুত মানবিক সহায়তা দিলেও পরবর্তী বছরগুলোতে শরণার্থী ইস্যু একটি ভারী বোঝায় পরিণত হয়। স্থানীয় জনগণের অসন্তোষ, বন উজাড়, বেকারত্ব ও মাদক পাচারের মতো সমস্যাও যুক্ত হয়েছে। সরকার বহুবার জানিয়েছে, আরেক দফা ঢল সামলানোর মতো অবকাঠামো বা সম্পদ আর নেই।
তবুও বাস্তবতা হলো—রাখাইনের পরিস্থিতি খারাপ হলে সীমান্তে ঢল ঠেকানো কঠিন হবে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ বাধ্য হবে অন্তত কিছু অংশকে আশ্রয় দিতে।

আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
- • ভারত: তারা সবসময় রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে অনাগ্রহী এবং সীমান্ত সুরক্ষায় কঠোর অবস্থান নিয়েছে।
- • চীন: রাখাইনে তাদের অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। তারা মিয়ানমার সেনা ও আরাকান আর্মির মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করতে পারে, তবে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে প্রায় নীরব।
- • আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়: পশ্চিমা দেশগুলো মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ জানালেও কার্যকর সমাধান দেয়নি। বরং এই বোঝা বাংলাদেশের কাঁধেই চাপিয়ে রেখেছে।
ভবিষ্যৎ চিত্র
যদি রোহিঙ্গারা আবারও বাংলাদেশে ঢল নামে, তবে—
- • দেশের অর্থনীতি আরও চাপে পড়বে।

- • নিরাপত্তাজনিত সমস্যা বাড়বে।
- • আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে আবারও সহায়তা চাইতে হবে।
কিন্তু সহায়তা পাওয়া নিশ্চিত নয়, কারণ বিশ্বব্যবস্থা বর্তমানে ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা সংঘাত এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার মতো সংকটে ব্যস্ত।
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বর্তমান পরিস্থিতি স্পষ্টতই ভয়াবহ। তারা একদিকে সেনাদের দমননীতির শিকার, অন্যদিকে বিদ্রোহী গোষ্ঠীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রোহিঙ্গা মিলিট্যান্টদের নতুন করে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা। সবকিছু মিলিয়ে মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা প্রবল, যা বাংলাদেশের জন্য নতুন এক রোহিঙ্গা ঢলের ঝুঁকি তৈরি করছে।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গা সংকটে চরম চাপের মধ্যে আছে। যদি রাখাইনের পরিস্থিতি দ্রুত না বদলায় এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তবে খুব শিগগির বাংলাদেশের সীমান্তে আবারও হাজার হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী জড়ো হতে পারে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















