ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ভিপি পদপ্রার্থী জালাল আহমেদ ওরফে ‘জ্বালাময়ী জালাল’-এর বিরুদ্ধে তার রুমমেট মো. রবিউল হককে ছুরিকাঘাতের অভিযোগ উঠেছে। জালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের টেলিভিশন অ্যান্ড ফিল্ম বিভাগের শিক্ষার্থী এবং মুহসীন হলের আবাসিক ছাত্র। অপরদিকে, রবিউল হক রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী।
ঘটনার সময় ও স্থান
বুধবার রাত পৌনে একটার দিকে মুহসীন হলের চারশো বাষট্টি নম্বর কক্ষে এ ঘটনা ঘটে। রুমের ভেতরেই তাদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক থেকে এই সহিংসতা শুরু হয়।
আহত রবিউল আত্মরক্ষার চেষ্টা করে রুম থেকে বের হয়ে আসেন এবং সহপাঠীরা তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।
আহত শিক্ষার্থীর বক্তব্য
রবিউল হকের অভিযোগ, জালাল রাতে হঠাৎ রুমে ঢুকে লাইট জ্বালিয়ে উচ্চ শব্দ করতে থাকেন। এতে ঘুম ভেঙে গেলে রবিউল তাকে শব্দ কমাতে বলেন, কারণ সকালে তার লাইব্রেরিতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। এ নিয়ে কথা-কাটাকাটি হলে জালাল তাকে ‘অবৈধ’ ও ‘বহিরাগত’ বলে গালাগালি করেন এবং একপর্যায়ে আক্রমণ চালান।
জালালের পাল্টা দাবি
অন্যদিকে, জালাল আহমেদ ফেসবুকে পোস্ট করে দাবি করেন, রবিউল অবৈধভাবে হলে থাকছিলেন এবং তাকে মারধর করেছেন। তিনি নিজের শরীরের আঘাতের ছবিও প্রকাশ করেন। জালালের ভাষায়, তিনি অবৈধ শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করার জন্য উকিল নোটিশ পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, আর তখনই হামলার শিকার হন।
শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া
ঘটনার পর মুহসীন হলের শিক্ষার্থীরা জালালের কক্ষের সামনে জড়ো হয়ে তাকে বের হয়ে আসতে বলেন। তবে তিনি ভেতর থেকে দরজা আটকে রাখেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও প্রাধ্যক্ষের সহযোগিতায় তাকে শাহবাগ থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়।
আন্দোলন ও দাবিদাওয়া
এই ঘটনার জেরে শিক্ষার্থীরা জালালের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছেন। তারা তার বহিষ্কার ও শাস্তির পাশাপাশি মুহসীন হলের প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগও দাবি করছেন। প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ছাত্রদের আন্দোলন চলছিল।
প্রক্টর এবং প্রাধ্যক্ষ শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করেছেন যে, জালাল আহমেদকে বিশ্ববিদ্যালয় এবং হল থেকে বহিষ্কারের ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সামাজিক-রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
নির্বাচনী প্রার্থীর ভাবমূর্তি সংকটে
ডাকসু নির্বাচনকে ঘিরে প্রার্থীদের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক ভাবমূর্তি গুরুত্বপূর্ণ। জালাল আহমেদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ তার ইমেজকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ছাত্রনেতার কাছ থেকে ধৈর্য ও নেতৃত্বের গুণ আশা করা হলেও সহিংস আচরণের অভিযোগ সরাসরি তার নেতৃত্বগুণকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
হল সংস্কৃতিতে সহিংসতার ধারাবাহিকতা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ছাত্ররাজনীতির ক্ষমতার ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। রাজনৈতিক বিরোধ, রুম দখল বা প্রভাব বিস্তারের কারণে সহিংসতা বহুবার ঘটেছে। এই ঘটনাটি ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব থেকে শুরু হলেও সেটি সেই সহিংস ধারাবাহিকতারই অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা
শিক্ষার্থীরা শুধু অভিযুক্তের শাস্তি নয়, বরং প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ দাবি করেছেন। এটি প্রশাসনিক কাঠামোর ওপর শিক্ষার্থীদের আস্থাহীনতাকে প্রকাশ করে। অতীতে অনেক ঘটনায় দোষীরা পার পেয়ে গেছে বলে শিক্ষার্থীরা এবারই শক্ত অবস্থান নিয়েছেন।
“অবৈধ শিক্ষার্থী” বিতর্ক
হলগুলোতে বহিরাগত বা অবৈধ শিক্ষার্থী থাকার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। রাজনৈতিক আশ্রয়ে অনেকে আবাসিক কক্ষ দখল করে থাকে। জালালের দাবি ও রবিউলের অবস্থান—উভয় দিকই এই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাকে আবার সামনে এনেছে।
জাতীয় রাজনীতির প্রতিচ্ছবি
ডাকসু নির্বাচন বরাবরই জাতীয় রাজনীতির প্রতিচ্ছবি। একজন প্রার্থীর সঙ্গে সহিংসতার অভিযোগ ছাত্ররাজনীতির সামগ্রিক বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এটি সমাজে সেই ধারণা আরও জোরদার করছে যে ছাত্রনেতারা শিক্ষার্থীদের স্বার্থ নয়, বরং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব নিয়েই বেশি ব্যস্ত।
এই ঘটনা কেবল একজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ নয়; এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, প্রশাসনিক সীমাবদ্ধতা ও ছাত্ররাজনীতির গভীর সংকটের প্রতিফলন। শিক্ষার্থীরা ন্যায্য শাস্তির পাশাপাশি জবাবদিহিতা চাইছেন। প্রশাসন যদি যথাযথ ব্যবস্থা না নেয়, তবে এটি শুধু ডাকসু নির্বাচন নয়, পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকেই আরও অনিশ্চিত করে তুলবে।
ডাকসু ভিপি প্রার্থীর বিরুদ্ধে ছুরিকাঘাতের অভিযোগ: ঘটনা ও প্রভাব
-
সারাক্ষণ রিপোর্ট - ১১:০৭:০৪ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ২৭ অগাস্ট ২০২৫
- 53
জনপ্রিয় সংবাদ




















