১০:০৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৫
তাইওয়ানের স্যাটেলাইট যুগের সূচনা: স্পেসএক্স উৎক্ষেপণে বড় অগ্রগতি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঢাকা (পর্ব-৫৯) শেয়ারবাজারে টানা উত্থান, বিনিয়োগকারীদের মনোভাব আরও ইতিবাচক সিরাজগঞ্জে ব্র্যাক–ফিলিপস ফাউন্ডেশনের নতুন চার হেলথ সেন্টার প্রশান্ত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কমলেও আস্থার লড়াইয়ে এগোচ্ছে চীন কাশ্মীরি মানেই সন্ত্রাসী নন- ওমর আব্দুল্লাহ গোপন সস রক্ষায় কঠোর নজরদারি: রেইজিং কেইনসের রহস্যময় নিরাপত্তা ব্যবস্থা খাশোগি হত্যাকাণ্ডে সিআইএ–এর মূল্যায়নকে অস্বীকার করলেন ট্রাম্প ট্রাম্পের কৃষিপণ্য শুল্ক ছাড়ে যুক্তরাষ্ট্রে বাড়তে পারে ভারতের রপ্তানি ডেঙ্গুতে আরও ৬ জনের মৃত্যু, ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ৭৮৮ রোগী

মেঘ পাহাড়ের কংস বয়ে চলে ময়মসিংহ এর বির্স্তীর্ণ এলাকা জুড়ে

কংস নদীর নামেই এক জনপদের পরিচয়

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের কাছে কংস নদী শুধু একটি জলধারার নাম নয়, বরং জীবনযাত্রার অঙ্গ। স্থানীয়ভাবে একে অনেকে “কংসা” বা “কংসাই” নামে ডাকেন। মেঘালয় পাহাড়ের গারো ও খাসিয়া অঞ্চলের বৃষ্টিধারা থেকে জন্ম নেওয়া এই নদী ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার বিস্তীর্ণ এলাকা অতিক্রম করেছে। এ নদীকে ঘিরে কৃষক, জেলে, নৌকার মাঝি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে গারো-হাজংসহ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা গড়ে উঠেছে।

অতীতে নদীর পানি ছিল স্বচ্ছ, গভীর ও প্রাণবন্ত। বর্ষার সময় ফুলে-ফেঁপে ওঠা নদী চারপাশে ছড়িয়ে দিত উর্বর পলল, শীতে রূপ নিত নৌপথের প্রধান যোগাযোগ সড়ক হিসেবে। আজ যদিও নদীটি নানা সংকটে আক্রান্ত, তবু এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না।

ভৌগোলিক উৎপত্তি ও প্রবাহপথ

কংস নদীর উৎপত্তি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বৃষ্টিবহুল পাহাড়ি অঞ্চলে। ঝরনা, খাল ও ছোট ছোট জলধারা একত্রিত হয়ে নদীটি গড়ে তোলে স্রোতস্বিনী রূপ। ভারতীয় ভূখণ্ড অতিক্রম করে এটি প্রথমে শেরপুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এরপর ধোবাউড়া, হালুয়াঘাট, দুর্গাপুর, বারহাট্টা ও কলমাকান্দা অঞ্চলে প্রবাহিত হয়। দুর্গাপুরের পাথর খনি এলাকায় নদীটির জলধারা পাহাড়ি চরিত্র ধরে রাখে।

প্রাচীনকালে এটি সোমেশ্বরী নদীর শাখা হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে নিজস্ব গতিপথ তৈরি করে কংস আলাদা সত্তা অর্জন করে। নদীর দুই তীর ধরে অসংখ্য গ্রাম গড়ে উঠেছে। বর্ষায় প্রবল স্রোতে তীর ভাঙন ঘটে, আবার শীতে নদী নৌকা চলাচলের উপযোগী থাকে। ভৌগোলিকভাবে এ নদী সীমান্তবর্তী জনপদ ও সমতল অঞ্চলের মধ্যে এক অদৃশ্য সেতুবন্ধন।

অর্থনীতির প্রাণসঞ্চারক

কংস নদীর অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এ নদী একসময় ছিল মাছের ভাণ্ডার। বোয়াল, শোল, পাবদা, টাকি, আইড়সহ অসংখ্য দেশীয় মাছের প্রজাতি এখানে পাওয়া যেত। জেলেদের জীবিকা, স্থানীয় জনগণের খাদ্য চাহিদা ও আঞ্চলিক বাজারের সরবরাহ—সবই এ নদীর মাছকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো।

নদীর পলল মাটি কৃষিক্ষেত্রকে করেছে উর্বর। ধান, আখ, তামাক, আলু, সবজি—সবই কংস নদীর তীরবর্তী জমিতে ভালো হতো। কৃষকরা বিশ্বাস করতেন, নদীর কৃতজ্ঞতায় তাদের ফসল পরিপূর্ণতা পায়।

এছাড়া দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা বাজার এ নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। এখান থেকে কৃষিপণ্য, কাঠ, পাথরসহ বিভিন্ন কাঁচামাল নৌপথে দেশের নানা প্রান্তে পৌঁছে যেত। ফলে কংস নদী এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখত এক জীবনধারার মতো।

যোগাযোগ ও নৌপরিবহনের ঐতিহ্য

এক সময় বাংলাদেশের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম ছিল নদীপথ। কংস নদীও এর বাইরে নয়। দুর্গাপুর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত নৌপথ ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। বড় বড় ডিঙি, পালতোলা নৌযান কিংবা মালবাহী নৌকা কৃষিপণ্য, কাঠ, পাথর ও মাছ পরিবহনে ব্যবহার হতো।

শীতকালে যখন সড়ক কাদা ও ধুলাবালিতে ভুগত, তখন নৌকাই ছিল ভরসা। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়া, হাটে যাওয়া কিংবা ব্যবসায়িক লেনদেন—সবকিছুই নৌপথে সহজে হতো।

অতীতে নৌভ্রমণ শুধু যাতায়াত নয়, ছিল সাংস্কৃতিক আনন্দও। মাঝিদের ভাটিয়ালি গান, যাত্রীদের মিলন আর নদীর ঢেউ—সব মিলিয়ে কংস নদী ছিল প্রাণের স্পন্দন। যদিও আজ এই চিত্র অনেকটাই হারিয়ে গেছে, তবুও প্রবীণরা স্মৃতিচারণে আবেগাপ্লুত হন।

সংস্কৃতির ধারক নদী

কংস নদীকে ঘিরে মানুষের সংস্কৃতি বৈচিত্র্যময় হয়েছে। গারো ও হাজং জনগোষ্ঠীর লোকসংস্কৃতিতে এই নদীর প্রভাব স্পষ্ট। বর্ষার সময় মাছ ধরা, নৌকা দৌড়, নদীর তীরে মেলা—সবই স্থানীয় সংস্কৃতির অংশ ছিল।

দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা অঞ্চলে একসময় “কংস মেলা” বসতো, যেখানে বাউল, জারি-সারি, পালাগান ও ভাটিয়ালি গানের আসর বসত। মাঝিদের গান নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে তৈরি করত এক অপূর্ব আবহ।

সামাজিকভাবেও নদী মানুষকে একত্র করেছে। বিবাহ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও সামাজিক আয়োজন প্রায়শই নদীপথ নির্ভর ছিল। এভাবেই কংস নদী এ অঞ্চলের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে বিশেষ ছাপ রেখে গেছে।

বর্তমান সংকট

কালের পরিক্রমায় কংস নদী এখন এক অস্তিত্বসংকটে।

  • নাব্যতা হারাচ্ছে: পলি জমে তলদেশ ভরাট হয়েছে। নৌযান চলাচল প্রায় বন্ধ।
  • দূষণ: কৃষিজ কীটনাশক, গৃহস্থালি বর্জ্য ও শিল্পবর্জ্য নদীর পানিকে দূষিত করছে। মাছের প্রজাতি দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।
  • অবৈধ দখল: নদীর দুই তীর দখল করে বসতি, বাজার ও দোকানপাট গড়ে উঠেছে। প্রবাহ সংকুচিত হয়ে বর্ষায় ভয়াবহ বন্যা হচ্ছে।

  • জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: বর্ষায় অতিবৃষ্টি আর শীতে অস্বাভাবিক খরা নদীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে।

একসময়ের প্রাণবন্ত নদীটি আজ প্রায় মৃতপ্রায়।

সম্ভাবনা ও পুনরুদ্ধারের উপায়

সব সংকট সত্ত্বেও কংস নদীর সম্ভাবনা অগাধ। নদী খনন করলে নৌযান চলাচল পুনরায় শুরু হতে পারে। দূষণমুক্ত করার উদ্যোগ নিলে দেশীয় মাছের প্রজাতি ফিরে আসতে পারে।

এছাড়া দুর্গাপুরের পাথর খনি ও গারো পাহাড় ঘিরে নদীভিত্তিক পর্যটন শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। নৌভ্রমণ, পাহাড়ি ট্রেকিং, লোকসংস্কৃতি—সব মিলিয়ে কংস নদী হতে পারে পর্যটনের এক নতুন গন্তব্য।

স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে নদী সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করলে কংস আবারও তার প্রাচীন ঐতিহ্য ফিরে পেতে পারে।

কংস নদী কেবল একটি নদী নয়, এটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের জীবন, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। বহু শতাব্দী ধরে এটি মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অথচ আজ এটি দখল, দূষণ ও অবহেলায় মৃতপ্রায়।

যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হলে কংস নদী আবারও প্রবাহমান রূপ ফিরে পাবে। এ নদী রক্ষা করা মানে শুধু একটি জলধারা নয়, বরং এক অঞ্চল, এক সংস্কৃতি এবং হাজারো মানুষের অস্তিত্বকে রক্ষা করা।

জনপ্রিয় সংবাদ

তাইওয়ানের স্যাটেলাইট যুগের সূচনা: স্পেসএক্স উৎক্ষেপণে বড় অগ্রগতি

মেঘ পাহাড়ের কংস বয়ে চলে ময়মসিংহ এর বির্স্তীর্ণ এলাকা জুড়ে

০৭:০০:৫৬ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৭ অগাস্ট ২০২৫

কংস নদীর নামেই এক জনপদের পরিচয়

বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের কাছে কংস নদী শুধু একটি জলধারার নাম নয়, বরং জীবনযাত্রার অঙ্গ। স্থানীয়ভাবে একে অনেকে “কংসা” বা “কংসাই” নামে ডাকেন। মেঘালয় পাহাড়ের গারো ও খাসিয়া অঞ্চলের বৃষ্টিধারা থেকে জন্ম নেওয়া এই নদী ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার বিস্তীর্ণ এলাকা অতিক্রম করেছে। এ নদীকে ঘিরে কৃষক, জেলে, নৌকার মাঝি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে গারো-হাজংসহ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা গড়ে উঠেছে।

অতীতে নদীর পানি ছিল স্বচ্ছ, গভীর ও প্রাণবন্ত। বর্ষার সময় ফুলে-ফেঁপে ওঠা নদী চারপাশে ছড়িয়ে দিত উর্বর পলল, শীতে রূপ নিত নৌপথের প্রধান যোগাযোগ সড়ক হিসেবে। আজ যদিও নদীটি নানা সংকটে আক্রান্ত, তবু এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা অস্বীকার করা যায় না।

ভৌগোলিক উৎপত্তি ও প্রবাহপথ

কংস নদীর উৎপত্তি ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বৃষ্টিবহুল পাহাড়ি অঞ্চলে। ঝরনা, খাল ও ছোট ছোট জলধারা একত্রিত হয়ে নদীটি গড়ে তোলে স্রোতস্বিনী রূপ। ভারতীয় ভূখণ্ড অতিক্রম করে এটি প্রথমে শেরপুর সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এরপর ধোবাউড়া, হালুয়াঘাট, দুর্গাপুর, বারহাট্টা ও কলমাকান্দা অঞ্চলে প্রবাহিত হয়। দুর্গাপুরের পাথর খনি এলাকায় নদীটির জলধারা পাহাড়ি চরিত্র ধরে রাখে।

প্রাচীনকালে এটি সোমেশ্বরী নদীর শাখা হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে নিজস্ব গতিপথ তৈরি করে কংস আলাদা সত্তা অর্জন করে। নদীর দুই তীর ধরে অসংখ্য গ্রাম গড়ে উঠেছে। বর্ষায় প্রবল স্রোতে তীর ভাঙন ঘটে, আবার শীতে নদী নৌকা চলাচলের উপযোগী থাকে। ভৌগোলিকভাবে এ নদী সীমান্তবর্তী জনপদ ও সমতল অঞ্চলের মধ্যে এক অদৃশ্য সেতুবন্ধন।

অর্থনীতির প্রাণসঞ্চারক

কংস নদীর অর্থনৈতিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। এ নদী একসময় ছিল মাছের ভাণ্ডার। বোয়াল, শোল, পাবদা, টাকি, আইড়সহ অসংখ্য দেশীয় মাছের প্রজাতি এখানে পাওয়া যেত। জেলেদের জীবিকা, স্থানীয় জনগণের খাদ্য চাহিদা ও আঞ্চলিক বাজারের সরবরাহ—সবই এ নদীর মাছকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হতো।

নদীর পলল মাটি কৃষিক্ষেত্রকে করেছে উর্বর। ধান, আখ, তামাক, আলু, সবজি—সবই কংস নদীর তীরবর্তী জমিতে ভালো হতো। কৃষকরা বিশ্বাস করতেন, নদীর কৃতজ্ঞতায় তাদের ফসল পরিপূর্ণতা পায়।

এছাড়া দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা বাজার এ নদীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। এখান থেকে কৃষিপণ্য, কাঠ, পাথরসহ বিভিন্ন কাঁচামাল নৌপথে দেশের নানা প্রান্তে পৌঁছে যেত। ফলে কংস নদী এ অঞ্চলের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখত এক জীবনধারার মতো।

যোগাযোগ ও নৌপরিবহনের ঐতিহ্য

এক সময় বাংলাদেশের প্রধান যোগাযোগ মাধ্যম ছিল নদীপথ। কংস নদীও এর বাইরে নয়। দুর্গাপুর থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত নৌপথ ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। বড় বড় ডিঙি, পালতোলা নৌযান কিংবা মালবাহী নৌকা কৃষিপণ্য, কাঠ, পাথর ও মাছ পরিবহনে ব্যবহার হতো।

শীতকালে যখন সড়ক কাদা ও ধুলাবালিতে ভুগত, তখন নৌকাই ছিল ভরসা। আত্মীয়স্বজনের বাড়ি যাওয়া, হাটে যাওয়া কিংবা ব্যবসায়িক লেনদেন—সবকিছুই নৌপথে সহজে হতো।

অতীতে নৌভ্রমণ শুধু যাতায়াত নয়, ছিল সাংস্কৃতিক আনন্দও। মাঝিদের ভাটিয়ালি গান, যাত্রীদের মিলন আর নদীর ঢেউ—সব মিলিয়ে কংস নদী ছিল প্রাণের স্পন্দন। যদিও আজ এই চিত্র অনেকটাই হারিয়ে গেছে, তবুও প্রবীণরা স্মৃতিচারণে আবেগাপ্লুত হন।

সংস্কৃতির ধারক নদী

কংস নদীকে ঘিরে মানুষের সংস্কৃতি বৈচিত্র্যময় হয়েছে। গারো ও হাজং জনগোষ্ঠীর লোকসংস্কৃতিতে এই নদীর প্রভাব স্পষ্ট। বর্ষার সময় মাছ ধরা, নৌকা দৌড়, নদীর তীরে মেলা—সবই স্থানীয় সংস্কৃতির অংশ ছিল।

দুর্গাপুর ও কলমাকান্দা অঞ্চলে একসময় “কংস মেলা” বসতো, যেখানে বাউল, জারি-সারি, পালাগান ও ভাটিয়ালি গানের আসর বসত। মাঝিদের গান নদীর ঢেউয়ের সঙ্গে মিশে তৈরি করত এক অপূর্ব আবহ।

সামাজিকভাবেও নদী মানুষকে একত্র করেছে। বিবাহ, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও সামাজিক আয়োজন প্রায়শই নদীপথ নির্ভর ছিল। এভাবেই কংস নদী এ অঞ্চলের সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনে বিশেষ ছাপ রেখে গেছে।

বর্তমান সংকট

কালের পরিক্রমায় কংস নদী এখন এক অস্তিত্বসংকটে।

  • নাব্যতা হারাচ্ছে: পলি জমে তলদেশ ভরাট হয়েছে। নৌযান চলাচল প্রায় বন্ধ।
  • দূষণ: কৃষিজ কীটনাশক, গৃহস্থালি বর্জ্য ও শিল্পবর্জ্য নদীর পানিকে দূষিত করছে। মাছের প্রজাতি দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।
  • অবৈধ দখল: নদীর দুই তীর দখল করে বসতি, বাজার ও দোকানপাট গড়ে উঠেছে। প্রবাহ সংকুচিত হয়ে বর্ষায় ভয়াবহ বন্যা হচ্ছে।

  • জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: বর্ষায় অতিবৃষ্টি আর শীতে অস্বাভাবিক খরা নদীর প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছে।

একসময়ের প্রাণবন্ত নদীটি আজ প্রায় মৃতপ্রায়।

সম্ভাবনা ও পুনরুদ্ধারের উপায়

সব সংকট সত্ত্বেও কংস নদীর সম্ভাবনা অগাধ। নদী খনন করলে নৌযান চলাচল পুনরায় শুরু হতে পারে। দূষণমুক্ত করার উদ্যোগ নিলে দেশীয় মাছের প্রজাতি ফিরে আসতে পারে।

এছাড়া দুর্গাপুরের পাথর খনি ও গারো পাহাড় ঘিরে নদীভিত্তিক পর্যটন শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব। নৌভ্রমণ, পাহাড়ি ট্রেকিং, লোকসংস্কৃতি—সব মিলিয়ে কংস নদী হতে পারে পর্যটনের এক নতুন গন্তব্য।

স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে নদী সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করলে কংস আবারও তার প্রাচীন ঐতিহ্য ফিরে পেতে পারে।

কংস নদী কেবল একটি নদী নয়, এটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের জীবন, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। বহু শতাব্দী ধরে এটি মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অথচ আজ এটি দখল, দূষণ ও অবহেলায় মৃতপ্রায়।

যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হলে কংস নদী আবারও প্রবাহমান রূপ ফিরে পাবে। এ নদী রক্ষা করা মানে শুধু একটি জলধারা নয়, বরং এক অঞ্চল, এক সংস্কৃতি এবং হাজারো মানুষের অস্তিত্বকে রক্ষা করা।