চীনা শিক্ষার্থীর স্রোত রাশিয়ায়
রাশিয়ার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চীনা শিক্ষার্থীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। ২০২২ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে এই সংখ্যা প্রায় ২৫ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১ হাজারে। মস্কোতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর বৈঠকের পর এই প্রবণতা আরও জোরদার হয়েছে। দুই দেশের ঘনিষ্ঠ কৌশলগত ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক শিক্ষাক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হচ্ছে।
বিকল্প আন্তর্জাতিক শিক্ষা ব্যবস্থার উত্থান
বিশ্লেষকদের মতে, শি–পুতিনের ‘সীমাহীন সম্পর্ক’ নতুন এক আন্তর্জাতিক শিক্ষা ব্যবস্থার ভিত্তি গড়ে দিচ্ছে। হংকং–ভিত্তিক গবেষণা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান চোজান-এর প্রতিষ্ঠাতা অ্যাশলি দুদারেনক বলেন, এটি আসলে বহুমেরু বিশ্ব ব্যবস্থার মানবিক অবকাঠামো। তাঁর অনুমান, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে রাশিয়ায় চীনা শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক লাখ ছাড়িয়ে যাবে। তুলনায় বর্তমানে যুক্তরাজ্যে চীনা শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেড় লাখেরও বেশি।

দুই দেশের শিক্ষা বিনিময়
বর্তমানে চীনে পড়ছে ২১ হাজার রাশিয়ান শিক্ষার্থী। দুই দেশের মধ্যে রয়েছে ১৬০টিরও বেশি স্নাতক ও স্নাতকোত্তর প্রোগ্রাম এবং অন্তত ২৭টি যৌথ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, রাশিয়ায় মাস্টার্স শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৩৬ শতাংশই চীনা। তোমস্ক স্টেট ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে পাওয়া গেছে ১৮টি সহযোগিতা কর্মসূচি, যেখানে দালিয়ান ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির মতো মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। চীনা শিক্ষার্থীরা বিশেষভাবে আকৃষ্ট হচ্ছে মেকাট্রনিক্স ও রোবোটিক্স, মেশিন সিস্টেম ডিজাইন, ম্যানেজমেন্ট টেকনোলজি, ব্যালিস্টিক্স ও এরোডাইনামিক্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়গুলোতে।
কেন রাশিয়া আকর্ষণীয়
মস্কো–ভিত্তিক ব্যবসা পরামর্শক ফিলিপ রোয়ের মতে, রাশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষ করে প্রযুক্তিনির্ভর পড়াশোনার মান বেশ ভালো। একইসঙ্গে পাশ্চাত্যের তুলনায় খরচ কম এবং স্কলারশিপ পাওয়ার সুযোগও বেশি। তিনি বলেন, পশ্চিমা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো রাশিয়া থেকে সরে যাওয়ার পর গাড়ি ও ইলেকট্রনিকস খাতে চীনা কোম্পানিগুলো দ্রুত জায়গা দখল করেছে। ফলে রাশিয়ায় ব্যবসা–বাণিজ্য বুঝতে পারে এমন চীনা শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন বাড়ছে।

কৌশলগত প্রতিভা তৈরি
চীনা শিক্ষার্থীরা মূলত পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরে চীনা কোম্পানিতে কাজ করছে, যারা রাশিয়ায় ব্যবসা পরিচালনা করছে বা দুই দেশের বাণিজ্যে যুক্ত। এটিকে শুধু অভিবাসন–ভিত্তিক শিক্ষা নয়, বরং নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক সম্পর্কের জন্য কৌশলগত প্রতিভা উন্নয়ন হিসেবে দেখা হচ্ছে। এসব শিক্ষার্থী বাণিজ্য, জ্বালানি, প্রকৌশল, স্বাস্থ্যসেবা ও কূটনীতির মতো খাতে এগিয়ে থাকছে। বিশেষ করে শি জিনপিং-এর ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড’ প্রকল্পের আওতায় মধ্য এশিয়ার রুশভাষী অঞ্চলে কাজ করতে তাদের বাড়তি সুবিধা হচ্ছে।
ডিগ্রি স্বীকৃতি ও সুবিধা
রাশিয়ার ডিগ্রি চীনে স্বীকৃত হওয়ায় স্নাতকরা সহজেই উচ্চবেতন ও চাহিদাসম্পন্ন চাকরি পাচ্ছে। দেশে ফিরে তারা ‘হাইগুই’ নামে পরিচিত বিশেষ সুবিধাও পাচ্ছে—এর মধ্যে রয়েছে শহরে বসবাসের অনুমতি, উদ্যোক্তা হওয়ার জন্য ভর্তুকি ও অগ্রাধিকারভিত্তিক নিয়োগ। শেনঝেন এমএসইউ–বিআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো যৌথ প্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের জন্য আরও পড়াশোনা ও চাকরির সুযোগ তৈরি করছে, যেখানে প্রায়ই ইন্টার্নশিপ ও গবেষণা প্রোগ্রাম থাকে।

পশ্চিমের সীমাবদ্ধতা ও রাশিয়ার সুযোগ
প্রাগ–ভিত্তিক চিন্তাকেন্দ্র এএমও’র বিশ্লেষক ফিলিপ নুবেল মনে করেন, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলে শুরু হওয়া সীমাবদ্ধ নীতি এই প্রবণতাকে ত্বরান্বিত করেছে। ট্রাম্প প্রশাসন চীনা শিক্ষার্থীদের ভিসা কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছিল। নুবেল বলেন, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা থেকে বিচ্ছিন্ন রাশিয়ার জন্য চীনা শিক্ষার্থীদের আগমন একপ্রকার জীবনরেখা, যা প্রমাণ করে রাশিয়া এখনও বৈশ্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার অংশ।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















