ভৌগোলিক অবস্থান ও প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য
বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্যতম জেলা বাগেরহাট নদীবেষ্টিত এক অঞ্চল। পাঙ্গুঁচি, দারাতানা, মধুমতি, পশুর, মংলা, বলেশ্বর, ভৈরব ও ভাংড়া নদীর পাশাপাশি এখানে রয়েছে কম পরিচিত হলেও গুরুত্বপূর্ণ ঘষিয়াখালী নদী। এ নদী সরাসরি গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার ডেল্টিক জটিলতার অংশ, যার প্রবাহ বাগেরহাটের জনপদের ভৌগোলিক রূপ, কৃষি ও জীববৈচিত্র্যে অবিচ্ছিন্ন প্রভাব বিস্তার করে আসছে।
নদীটির দুই পাড়ের জমি বেশ উর্বর। বর্ষাকালে নদী ফুলে-ফেঁপে ওঠে, আর শুকনো মৌসুমে এর পানিই হয়ে ওঠে এলাকার কৃষিজমি সেচের মূল ভরসা। প্রাকৃতিক মাছ, চিংড়ি ঘের, শামুক-ঝিনুক এবং ছোট জলজ প্রাণীর কারণে এটি স্থানীয় মানুষের জন্য একটি অর্থনৈতিক সম্পদও বটে।
নদীর সঙ্গে মানুষের জীবন
বাগেরহাটের মানুষ নদীনির্ভর জীবনযাপনে অভ্যস্ত। ঘসিরখালি নদী এ অঞ্চলের কৃষকদের ধান চাষে সেচ দেয়, জেলেদের জালে মাছ জোগায়, আবার অনেক গ্রামীণ মানুষের জন্য নিত্যদিনের পরিবহনের মাধ্যম। ছোট নৌকা কিংবা ডিঙি ভর করে এখানকার মানুষ হাটবাজারে যাতায়াত করে।
বিশেষত ফকিরহাট ও রামপাল অঞ্চলের চিংড়ি চাষাবাদে এ নদীর পানি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদী থেকে পানি নিয়ে আশপাশে বিস্তৃত ঘেরে চিংড়ি চাষ করা হয়, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে। পাশাপাশি শীত মৌসুমে শুকনো নদীখাতে শাকসবজি চাষও করে অনেকে।

ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট
বাগেরহাট শুধু নদীমাতৃক অঞ্চলই নয়, এটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ একটি জেলা। ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য ‘ষাটগম্বুজ মসজিদ’ ও অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা নদীঘেঁষে গড়ে ওঠে। ভৈরব বা পশুর নদীর মতো বড় নদীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘসিরখালিও স্থানীয় গ্রামীণ জনপদের ধর্মীয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে প্রভাব ফেলেছে।
অনেক স্থানীয় লোককথা, গান এবং মেলার পেছনেও নদীর প্রভাব লক্ষ করা যায়। গ্রামবাংলার বিবাহ অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে সামাজিক উৎসবে নদীর পানি, নৌকা বা মাছকে ঘিরে নানান আচার-অনুষ্ঠান এখনও টিকে আছে।
সমকালীন সংকট ও পরিবেশগত সমস্যা
আজকের দিনে ঘসিরখালি নদীও বাংলাদেশের অন্যান্য নদীর মতো নানা সংকটের মুখোমুখি।
পলি জমে নাব্যতা হারাচ্ছে নদী। বর্ষাকালে অল্প কয়েক মাস পানি প্রবাহমান থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে নদীর তলদেশ শুকিয়ে যায়।
দখল ও ভরাট অন্যতম বড় সমস্যা। নদীর দুই পাড়ে বসতি, ইটভাটা ও ব্যবসায়িক স্থাপনা গড়ে উঠছে, যা নদীর প্রবাহ সংকুচিত করছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে লবণাক্ততা বৃদ্ধি এ নদীর মিষ্টি পানির মাছ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে।
সময়মতো ড্রেজিং কার্যক্রম না হওয়ায় পানির প্রবাহ স্বাভাবিক থাকে না, ফলে কৃষি ও নৌযান চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়।
কেন গুরুত্বপূর্ণ ঘষিয়াখালী নদী
১. অর্থনৈতিক সহায়ক: কৃষি, মাছ ধরা, চিংড়ি চাষ ও নৌ-পরিবহন এ নদীর ওপর নির্ভরশীল।
২. জীববৈচিত্র্যের আধার: নদীটি স্থানীয় জলজ প্রাণী ও গাছপালার ভারসাম্য রক্ষায় অবদান রাখে।
৩. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রবিন্দু: গ্রামীণ উৎসব, সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান এবং লোকজ সংস্কৃতির সঙ্গে নদী জড়িয়ে আছে।
৪. প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষাকারী: বন্যা নিয়ন্ত্রণ, ভূগর্ভস্থ পানি রিচার্জ এবং জলবায়ু স্থিতিশীল রাখতে এর ভূমিকা অপরিহার্য।
ভবিষ্যৎ সংরক্ষণ ও করণীয়
বৈজ্ঞানিক জরিপ ও তথ্য সংগ্রহ: ঘষিয়াখালী নদীর দৈর্ঘ্য, পানির গুণমান, প্রবাহের ধারা ইত্যাদি নিয়মিতভাবে নথিবদ্ধ করা জরুরি।
সঠিক ড্রেজিং পরিকল্পনা: নদীর তলদেশ পরিষ্কার করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
পাড় সংরক্ষণ প্রকল্প: টেকসই বাঁধ ও সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলে নদী ভাঙন রোধ করা প্রয়োজন।

জনসচেতনতা ও অংশগ্রহণ: স্থানীয় জনগণকে নদী রক্ষার কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করা হলে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান সম্ভব।
ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযোগ: নদী সংরক্ষণকে বাগেরহাটের প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য ও পর্যটনের সঙ্গে একীভূত করা গেলে এটি অর্থনীতিতেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
ঘষিয়াখালী নদী হয়তো মোংলা বা পশুর নদীর মতো বিখ্যাত নয়, কিন্তু বাগেরহাটের মানুষের জন্য এটি এক নীরব প্রাণরেখা। কৃষি, মাছ ধরা, সংস্কৃতি কিংবা পরিবেশ—সব কিছুর সঙ্গেই এর অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্ক। নদীটির প্রতি নতুন করে দৃষ্টি না দিলে এটি ধীরে ধীরে মৃতপ্রায় নদীতে পরিণত হবে। আর তাই, ঘসিরখালিকে বাঁচানো মানে বাগেরহাটের জীবন ও ভবিষ্যৎকে বাঁচানো।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















