সাঁওতালরা বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম আদিবাসী জনগোষ্ঠী। উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, নওগাঁ, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রংপুর অঞ্চলে তাদের বসতি বেশি। ঐতিহাসিকভাবে তারা অস্ট্রো-এশিয়াটিক মুন্ডা জনগোষ্ঠীর উত্তরসূরি বলে বিবেচিত। কৃষিকাজ, প্রকৃতিনির্ভর জীবনধারা এবং নিজস্ব ঐতিহ্য ধরে রাখার মধ্য দিয়ে তারা এক স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক পরিচয় গড়ে তুলেছে।
সামাজিক কাঠামো ও জীবনধারা
সাঁওতাল সমাজ বারোটি গোত্র বা কুলে বিভক্ত। তারা সাঁওতালি ভাষায় কথা বলে, যদিও এখন অনেকে বাংলাতেও সাবলীল। তাদের বাড়িঘর সাধারণত মাটির তৈরি, ছোট দরজা, সাদামাটা আসবাব এবং চারপাশে সবজি বা ফুলের বাগান থাকে।
নারীরা উজ্জ্বল রঙের ‘পাঁচি’ নামে পরিচিত শাড়ি পরিধান করেন, যা হাঁটুর নিচে পর্যন্ত নামে। ফুল, চুড়ি, গলার হার, পায়ের নূপুর ও চুলে সাজ তাদের নিত্যসঙ্গী। পুরুষেরা সাধারণত ধুতি বা লুঙ্গি পরে থাকেন।

ধর্মবিশ্বাস ও আচার
সাঁওতালদের ধর্মবিশ্বাস মূলত প্রকৃতিনির্ভর। তারা বন, নদী, পাহাড় ও জমিকে দেবতা হিসেবে মান্য করেন। কৃষিকাজ, ফসল ফলানো কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা উৎসবমুখর পূজা-অর্চনা করে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে অনেকে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছেন, তবে ঐতিহ্যবাহী আচার-অনুষ্ঠান এখনো তাদের সমাজে গুরুত্বপূর্ণ।
গান ও সঙ্গীত
সাঁওতাল সংস্কৃতির প্রাণ হচ্ছে গান। তাদের গান সাধারণত সমবেতভাবে গাওয়া হয়। এই গান প্রকৃতি, প্রেম, কৃষি, সংগ্রাম ও জীবনের আনন্দ-দুঃখকে কেন্দ্র করে রচিত।
তারা তুমডাক ও তামাকʼ নামের ঢোল, বাঁশি, সারেঙ্গা, বেহালা-সদৃশ ‘বানাম’, ঝাঁঝ ও করতাল ব্যবহার করে সঙ্গীত পরিবেশন করে। প্রতিটি যন্ত্র তাদের নাচ ও গানের তালকে প্রাণবন্ত করে তোলে।

নৃত্য ও উৎসব
সাঁওতাল সমাজে প্রচলিত কথা আছে— “বারো মাসে তেরো পার্বণ।” প্রায় প্রতিটি ঋতু ও কৃষিকাজের ধাপকে কেন্দ্র করেই তারা উৎসব পালন করে।
বাহা পরব (ফুল উৎসব)
বসন্তকালে এই উৎসব পালিত হয়। গাছে নতুন ফুল ফোটা এবং প্রকৃতির পুনর্জীবনকে কেন্দ্র করে এ উৎসবের আয়োজন। নারী-পুরুষ ফুল দিয়ে সাজসজ্জা করেন এবং ঢোলের তালে গান ও নাচে মেতে ওঠেন।
সোহারাই (ফসল উৎসব)
শীতকালের শেষে, অর্থাৎ পৌষ মাসের অন্তিম সময়ে পালিত হয় সোহারাই। এটি মূলত ধান কাটা শেষে ফসলের দেবতাকে ধন্যবাদ জানানোর উৎসব। ঢোল, বাঁশি আর সমবেত নাচের মাধ্যমে আনন্দ-উৎসব চলে কয়েকদিন।

নৃত্যের ধরণ
সাঁওতাল নারীরা সাধারণত হাত ধরে সারিবদ্ধভাবে নাচেন। তাদের লাল পাড়ের সাদা শাড়ি, মাথায় ফুল আর পায়ে নূপুর নাচের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে। পুরুষেরা মাদল, ঢোল, ঝাঁঝ ও বাঁশি বাজিয়ে নাচের সঙ্গ দেন। এই সম্মিলিত নাচ তাদের ঐক্য ও আনন্দের প্রতীক।
সংস্কৃতির আবেগ ও তাৎপর্য
সাঁওতালদের গান ও নাচ কেবল বিনোদন নয়, বরং তাদের অস্তিত্বের প্রতিচ্ছবি। এতে থাকে জীবনের দুঃখ, সংগ্রাম, প্রতিবাদ ও ভালোবাসার কাহিনি। ভূমি হারানোর বেদনা কিংবা জীবিকার সংগ্রাম, সবই ফুটে ওঠে তাদের সুরে ও ছন্দে।
বাংলাদেশের সাঁওতাল জনগোষ্ঠী আজও তাদের সংস্কৃতিকে অটুট রেখেছে। শত প্রতিকূলতা, ভূমি দখল ও দারিদ্র্যের চাপ সত্ত্বেও তারা গান, নাচ, উৎসব ও আচার-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের পরিচয় বহন করছে। তাদের প্রতিটি ঢোলের তালে, প্রতিটি নৃত্যের ছন্দে প্রকৃতি ও সমাজের সঙ্গে গভীর সম্পর্কের বার্তা লুকিয়ে আছে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















