বিশ্বব্যাংক গত এপ্রিলে প্রকাশিত এক পডকাস্ট ও গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ বিশ্বে আরও অন্তত ৩ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যের কাতারে যুক্ত হতে পারে। বৈশ্বিক অর্থনীতি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার প্রভাবে এই নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বলে গবেষকরা সতর্ক করেছেন।
বাংলাদেশ একসময় দারিদ্র্য হ্রাসে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল। ১৯৯০ সালে যেখানে প্রায় অর্ধেক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে ছিল, সেখানে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সেই হার নেমে আসে ১৮–২০ শতাংশে। কিন্তু গত কয়েক বছরে নানা আঘাত—কোভিড-পরবর্তী মন্দা, বৈদেশিক মুদ্রা সংকট, যুদ্ধজনিত প্রভাব ও জলবায়ু বিপর্যয়, রাজনৈতিক বিপর্যয়—একত্র হয়ে দারিদ্র্যকে আবারও বাড়িয়ে তুলছে। কেন এই অস্বাভাবিক দারিদ্র্য বৃদ্ধি পাচ্ছে, তার কারণগুলো বিশদভাবে আলোচনা করা হলো।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ও বাংলাদেশের আঘাত
বিশ্বব্যাপী অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি এখনো মহামারির ক্ষতি থেকে পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ইউক্রেন যুদ্ধ ও জ্বালানি সংকট বৈশ্বিক সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে দিয়েছে। উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলো, বিশেষত আমদানি-নির্ভর দেশগুলো, এর মারাত্মক ক্ষতির শিকার। বাংলাদেশে এর প্রভাব পড়েছে সরাসরি: উৎপাদন খরচ বেড়েছে, শিল্প খাতে অর্ডার কমেছে এবং রপ্তানি বাজার অনিশ্চিত হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও এডিবি (এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক) এর তথ্য বলছে, প্রবৃদ্ধির হার গত দুই অর্থবছরে ৪ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। তুলনায় ভারত বা ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো কিছুটা স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছে। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি থমকে গেছে, নতুন উদ্যোক্তা গড়ে উঠছে না, যা নিম্ন আয়ের মানুষকে দরিদ্রতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

মূল্যস্ফীতি ও জীবনযাত্রার অস্থিরতা
বাংলাদেশের শহর ও গ্রামে এখন সবচেয়ে বড় সংকট হলো মূল্যস্ফীতি। গত দুই বছর ধরে খাদ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এক কেজি চাল, ডাল, তেল বা পেঁয়াজ কিনতে একজন শ্রমিককে তার দৈনিক আয়ের বড় অংশ ব্যয় করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ভোক্তা মূল্যসূচক ১০ শতাংশের কাছাকাছি অবস্থান করছে। তবে মাঠপর্যায়ে বাস্তব চিত্র আরও ভয়াবহ। কারণ, নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য খাদ্য ব্যয় তাদের মোট আয়ের প্রায় ৬০–৭০ শতাংশ দখল করে। ফলে একদিকে আয় কমছে, অন্যদিকে ব্যয় বাড়ছে—এটি দারিদ্র্য বৃদ্ধির সবচেয়ে দৃশ্যমান কারণ।
বৈদেশিক মুদ্রা সংকট ও আমদানি নির্ভরতা
ডলার সংকট বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে চরম চাপে ফেলেছে। এলসি খোলা কঠিন হয়ে পড়ায় কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হচ্ছে। শিল্পকারখানায় উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে, অনেক ক্ষুদ্র শিল্প বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
জ্বালানি আমদানির ওপরও এর বড় প্রভাব পড়ছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বারবার বাড়ানো হয়েছে, যা শিল্প ও কৃষি উভয় খাতেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ছোট ব্যবসায়ী বা কৃষক উৎপাদন খরচ সামলাতে না পেরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এভাবে হাজারো পরিবার আয়ের উৎস হারাচ্ছে।

রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ অর্থনীতির অন্যতম স্তম্ভ হলো প্রবাসী আয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে হুন্ডি প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমছে। আবার বৈশ্বিক মন্দার কারণে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে কর্মসংস্থানও সংকুচিত হচ্ছে।
অন্যদিকে তৈরি পোশাক খাত, যা বাংলাদেশের রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি জোগান দেয়, সেখানে অর্ডার কমেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ক্রেতারা মন্দার কারণে নতুন অর্ডার কম দিচ্ছে। ফলে অনেক গার্মেন্ট শ্রমিক ছাঁটাই বা বেকার হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে। এর প্রভাব সরাসরি দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ওপর পড়ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগের প্রভাব
বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, নদীভাঙন প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করছে। উপকূলীয় অঞ্চলে লবণাক্ততা বেড়ে জমি অনাবাদী হয়ে যাচ্ছে। নদীভাঙনে কৃষক পরিবার গৃহহীন হচ্ছে।
উপকূল থেকে শহরে ছুটে আসা মানুষগুলো বস্তিতে আশ্রয় নিচ্ছে, যেখানে কর্মসংস্থান অনিশ্চিত, জীবনযাত্রা কঠিন। নগর দরিদ্রতার হার দিন দিন বাড়ছে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকা শহরের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করছে।
শিক্ষা ও দক্ষতার ঘাটতি
বাংলাদেশে দারিদ্র্যের চক্রের অন্যতম বড় কারণ হলো মানসম্মত শিক্ষার অভাব। পরিবারগুলো যখন দৈনন্দিন খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হিমশিম খায়, তখন সন্তানের পড়াশোনার খরচ বহন করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না। ফলে স্কুলে ঝরে পড়ার হার বাড়ছে।
অন্যদিকে কারিগরি ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার সীমাবদ্ধতার কারণে তরুণরা শ্রমবাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। তারা নিম্ন আয়ের কাজের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকে যাচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে দারিদ্র্যের হার বাড়াচ্ছে।

সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির সীমাবদ্ধতা
সরকার প্রতি বছর বিপুল অর্থ ব্যয় করে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে। কিন্তু বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার গবেষণায় দেখা যায়, এর একটি বড় অংশ সঠিকভাবে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছায় না।
বৈষম্য ও আয়ের অসমতা
বাংলাদেশে ধনী–গরিব বৈষম্য গত এক দশকে দ্রুত বেড়েছে। গিনি সূচকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ মানুষের আয় ও সম্পদ বহুগুণ বেড়েছে, অথচ নিম্ন আয়ের মানুষের বাস্তব আয় প্রায় স্থির বা হ্রাস পেয়েছে।
আয়ের এই অসমতা শুধু সামাজিক স্থিতিশীলতাকেই হুমকির মুখে ফেলছে না, বরং দারিদ্র্য হ্রাসের অর্জনকেও নষ্ট করছে। মধ্যবিত্তের একটি অংশও দরিদ্রতার দিকে ঠেলে যাচ্ছে।
নগর দরিদ্রতার উত্থান
ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও গাজীপুরের মতো শহরে দারিদ্র্যের নতুন ঢেউ তৈরি হয়েছে। গ্রাম থেকে কাজের সন্ধানে আসা মানুষগুলো বস্তিতে বসবাস করছে। কিন্তু অল্প বেতনের চাকরি, অস্থির বাজার ও উচ্চ বাসাভাড়ার কারণে তাদের জীবনমান নিম্নমুখী।
নগর দরিদ্ররা সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি থেকেও প্রায়ই বাদ পড়ে যায়, কারণ এ ধরনের সহায়তা সাধারণত গ্রামীণ এলাকায় বেশি কার্যকর। ফলে শহরে দারিদ্র্যের চক্র আরও গভীর হচ্ছে।

নারীর ওপর প্রভাব
দারিদ্র্যের অস্বাভাবিক বৃদ্ধির ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী ও শিশু। পরিবারে আয় কমে গেলে মেয়েদের স্কুল ছাড়তে বাধ্য করা হয়, অনেক সময় বাল্যবিবাহের শিকার হতে হয়।
শ্রমবাজারেও নারীরা অনিশ্চয়তার মুখে। তৈরি পোশাক খাত সংকটে পড়লে সবচেয়ে আগে নারী শ্রমিকদের ছাঁটাই করা হয়। ফলে তারা আবার গৃহস্থালি বা অস্থায়ী খাতে ঠেলে দেওয়া হয়, যেখানে আয় কম এবং সামাজিক নিরাপত্তা নেই।
সম্ভাব্য করণীয় ও নীতি প্রস্তাব
দারিদ্র্যের এই অস্বাভাবিক প্রবণতা ঠেকাতে অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো কয়েকটি জরুরি পদক্ষেপের পরামর্শ দিয়েছে—
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ : বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনা, ভর্তুকি ও আমদানি নীতিতে সংস্কার।
ডলার সংকট মোকাবিলা : রেমিট্যান্স বৈধ চ্যানেলে আনতে প্রণোদনা বৃদ্ধি এবং রপ্তানি খাত বৈচিত্র্যময় করা।
শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন : কারিগরি শিক্ষা ও ডিজিটাল দক্ষতা বাড়াতে বিনিয়োগ।

সামাজিক সুরক্ষা জোরদার : প্রকৃত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে সহায়তা পৌঁছানো এবং অনিয়ম কমানো।
জলবায়ু অভিযোজন কৌশল : উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে টেকসই জীবিকা নিশ্চিত করা ও পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো গড়ে তোলা।
নারী শ্রমিক সুরক্ষা : শ্রম অধিকার রক্ষা ও নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নে সহায়তা।
বাংলাদেশ দারিদ্র্য হ্রাসে বিশ্বের কাছে একসময় উদাহরণ ছিল। কিন্তু বৈশ্বিক সংকট, জলবায়ু দুর্যোগ, মূল্যস্ফীতি ও অভ্যন্তরীণ নীতিগত দুর্বলতার কারণে সেই অর্জন এখন বড় হুমকির মুখে। বিশ্বব্যাংকের সতর্কবার্তা কেবল পরিসংখ্যান নয়—এটি বাস্তব সংকটের প্রতিফলন।
যদি এখনই সমন্বিত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তবে বাংলাদেশের নিম্ন আয়ের মানুষ আরও গভীর দারিদ্র্যে নিমজ্জিত হবে, আর দারিদ্র্য হ্রাসের দশকব্যাপী সাফল্য হারিয়ে যাবে। তাই এখনই প্রয়োজন সাহসী সংস্কার ও সুশাসন, আর জনবান্ধব অর্থনৈতিক নীতি।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















