নয় বছরের এলিয়াহ আর বারো বছরের ড্যানিয়েল বাসে ওঠার পর ২৮ জুন থেকে নিখোঁজ। তাদের মা ক্যারোলিন ওডোর বিবিসিকে বলেছেন, তিনি ভীষণ আতঙ্কে আছেন দুই শিশুপুত্রের ভাগ্য নিয়ে, যারা দুই মাস আগে তাদের বাবার সঙ্গে হারিয়ে গেছে। ওই বাবা ছিলেন এক কুখ্যাত অনাহারপন্থী সম্প্রদায়ের ধর্মগুরুর অনুসারী।
ওডোর জানিয়েছেন, সম্প্রতি সম্প্রদায়টির সঙ্গে যুক্ত মৃত্যুর ঘটনার তদন্ত চলাকালীন তিনি তার স্বামীর মরদেহ মালিন্ডি শহরের একটি মর্গে শনাক্ত করেছেন।
গত জুলাই মাসে মালিন্ডির ভেতরাঞ্চলীয় গ্রাম কওয়া বিনজারো থেকে তার মরদেহ উদ্ধার হয়। এ গ্রামটি দূরবর্তী শাখাহোলা অরণ্যের কাছেই, যেখানে ২০২৩ সালে চার শতাধিক মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল—যা কেনিয়ার ইতিহাসে ধর্মীয় সম্প্রদায়-সংক্রান্ত সবচেয়ে ভয়াবহ গণমৃত্যুর ঘটনা।
ওডোর এখন অপেক্ষা করছেন সম্প্রতি খনন করা ৩০টিরও বেশি মরদেহের ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফলের জন্য।
“আমি ভীষণ ব্যথা অনুভব করেছি। তাকে ঠিকমতো চিনতে পারিনি। মরদেহ প্রায় পচে গিয়েছিল,” ৪০ বছর বয়সী ওডোর তার স্বামী স্যামুয়েল ওউইনো ওউইওকে শনাক্ত করার পর বলেন।
তিনি বিশ্বাস করেন তার দুই ছেলে—বারো বছরের ড্যানিয়েল আর নয় বছরের এলিয়াহ—তাদের ৪৫ বছর বয়সী বাবার সঙ্গে জুন মাসের শেষ দিকে কওয়া বিনজারোতে গিয়েছিল।

সহিংস ধর্মীয় শিক্ষা আর বদলে যাওয়া জীবন
স্বঘোষিত ধর্মগুরু পল মাকেঞ্জি বর্তমানে বিচারাধীন আছেন “শাখাহোলা গণহত্যা” মামলায়। তিনি হত্যার দায় অস্বীকার করেছেন। অভিযোগ রয়েছে, তিনি অনুসারীদের বলেছেন, না খেলে দ্রুত স্বর্গে পৌঁছানো যাবে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, তিনি কারাগার থেকেও অনুসারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছেন।
ওডোর বলেন, চার-পাঁচ বছর আগে তার স্বামী মাকেঞ্জির প্রচার শোনা শুরু করেছিলেন।
“তারপর থেকেই তিনি বদলে যান। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাতে চাইতেন না,” তিনি বলেন। “বাচ্চারা অসুস্থ হলে বলতেন, ঈশ্বর আরোগ্য দেবেন। তিনি এসব শিক্ষাকে সত্যি বলে বিশ্বাস করতেন।”
ওডোরের উদ্বেগ বাড়ে যখন তিনি বুঝতে পারেন তার স্বামী নিজের গ্রামে না গিয়ে শাখাহোলা অরণ্যের আশেপাশে চলে গেছেন।
ছেলেমেয়েদের স্কুল আর চিকিৎসা না করানো নিয়ে দুজনের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হয়। তারা দুজনে পশ্চিম কেনিয়ার বুসিয়া জেলার মুদুলুসিয়ায় লেক ভিক্টোরিয়ার কাছে ছয় সন্তান নিয়ে বসবাস করছিলেন।
“তার শিক্ষা আমার কাছে কোনো অর্থই রাখেনি। আমি বিশ্বাস করি ঈশ্বর আরোগ্য দেন, কিন্তু শিশুর অসুখ হলে হাসপাতালে নিতে হয়,” বলেন ওডোর।

শেষ যাত্রা আর নিখোঁজ হওয়া
২৮ জুন তার স্বামী দুই কনিষ্ঠ সন্তানকে নিয়ে চলে যান।
“তিনি বলেছিলেন, নিজের জন্মভিটায় যাচ্ছেন। শেষ ফোনে আমাকে বললেন, ‘আমরা চলে গেছি, ঈশ্বর তোমার সঙ্গে থাকুন।’ আমি বলেছিলাম, ‘যাত্রা শুভ হোক।’”
কিন্তু এরপর আর যোগাযোগ না করায় ওডোর সন্দিহান হন। পরে জানতে পারেন, তিনি হোমা বে জেলায় নিজের গ্রামে যাননি, বরং বাড়ি থেকে প্রায় ৯০০ কিলোমিটার দূরের কওয়া বিনজারোতে চলে গেছেন।
তিনি পুলিশকে জানান এবং পরিচিতদের মাধ্যমে খোঁজ শুরু করেন। কয়েক সপ্তাহ আগে খবর পান, মালিন্ডির মর্গে তার স্বামীর মতো দেখতে কারও মরদেহ রয়েছে।
১৯ আগস্ট তিনি সেখানে গিয়ে স্বামীর মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন। পুলিশ বলে, মরদেহটি ১৯ জুলাই কওয়া বিনজারো গ্রামে উদ্ধার হয়েছিল। সন্দেহজনক নিখোঁজের খবরে অভিযান চালিয়ে ঝোপের মধ্যে মরদেহটি পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে, তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছিল।
কর্তৃপক্ষ বলছে, কিছু ভুক্তভোগীকে অনাহারে মরতে বেশি সময় নিলে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল।
তদন্ত ও নতুন খনন অভিযান
কেনিয়ার প্রসিকিউটর কার্যালয়ের তদন্তে অন্তত ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে তিনজন ছিলেন মাকেঞ্জির অনুসারী।
২১ আগস্ট থেকে নতুন করে খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৩২টি মরদেহ এবং ৭০টির বেশি দেহাংশ উদ্ধার হয়েছে।
“আপনি মরদেহ উঠতে দেখেন, অথচ নিজের সন্তানদের খোঁজ জানেন না। এটা অসহনীয়,” বলেন ওডোর।

সরকারের পদক্ষেপ ও স্থানীয়দের ক্ষোভ
কেনিয়ার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ড. রেমন্ড ওমোলো বলেছেন, সরকার ধর্মীয় উগ্রবাদ মোকাবিলায় নতুন আইন প্রণয়নের পরিকল্পনা করছে।
“আমরা একটি ধর্মবিষয়ক বিল প্রণয়ন করছি। এতে নির্ধারিত থাকবে—কোনো সংগঠনের সংবিধান আছে কিনা, নেতৃত্ব কারা, তাদের যোগ্যতা কী ইত্যাদি,” তিনি বলেন।
এদিকে কওয়া বিনজারো সংলগ্ন অরণ্যে খননকাজ সাময়িকভাবে স্থগিত রয়েছে। ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা মরদেহগুলো পরীক্ষা করবেন।
কিন্তু স্থানীয়দের জন্য এটি নতুন ভোগান্তি তৈরি করেছে। “আমরা কাঠ আর জ্বালানির জন্য অরণ্যের ওপর নির্ভর করি। এখন সেখানে যেতে দিচ্ছে না। এই সম্প্রদায়গুলোর কার্যক্রম একেবারে বন্ধ করতে হবে,” বলেন স্থানীয় বাসিন্দা জর্জ কন্ডে।
মায়ের অপেক্ষা
ওডোর এখনো অপেক্ষা করছেন তার দুই ছেলের খোঁজ পাওয়ার জন্য।
“আমি ভেবেছিলাম, এক ছেলে সপ্তম শ্রেণিতে উঠবে, অন্যজন চতুর্থ শ্রেণিতে। এখন যখনই স্কুলের ইউনিফর্ম পরা কোনো বাচ্চা দেখি, বুক ভেঙে যায়। আমি জানি না তারা কেমন আছে,” তিনি বলেন।
বিবিসি নিউজ, নাইরোবি থেকে




















