ফনম পেন–যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের ৩ হাজার শতাংশেরও বেশি চাপ অথবা কারখানা বন্ধের বিকল্পের মুখে দাঁড়িয়ে পড়েছিলেন কাম্বোডিয়ার উদ্যোক্তা ও মানবসম্পদ পরিচালক থাং মেংহৌত। তবে তিনি পুরোপুরি সৌরশক্তি শিল্প থেকে সরে আসতে চাননি।
নতুন কৌশল
চীন-সমর্থিত তার প্রতিষ্ঠান ভেনাস এনার্জি ও ভিকম পাওয়ার সিস্টেম এ বছর সৌর মডিউল উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে, কারণ এসব পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে রফতানির সময় বিশাল শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এর পরিবর্তে তারা এখন পাতলা ফিল্ম সোলার প্যানেল তৈরি করছে, যেগুলোর ওপর মাত্র ১৯ শতাংশ শুল্ক প্রযোজ্য। যদিও এ প্যানেলগুলো তৈরির খরচ বেশি, তবে বহনযোগ্য এবং তুলনামূলক কম শাস্তিমূলক শুল্কে যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করা যায়।
মেংহৌত বলেন, “আগে আমাদের পাঁচটি কোম্পানি ছিল, এখন মাত্র দুটি। যদি আবার শুল্ক বাড়ানো হয়, তাহলে আর সম্ভব হবে না।”

সৌরশিল্পের উত্থান ও পতন
২০১৮ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে কাম্বোডিয়ায় ডজনখানেক সৌর কারখানা চালু হয়, যেখানে কয়েক হাজার কর্মী কাজ করত। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে সৌরপণ্য রফতানি শীর্ষে পৌঁছায়—২.৪ বিলিয়ন ডলার, যা পোশাক-জুতার বাইরে দেশের সবচেয়ে বড় রফতানি খাত হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে সৌর রফতানি কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪.৪ মিলিয়ন ডলারে। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তর দাবি করেছে, কাম্বোডিয়া ও অন্যান্য দেশ চীন থেকে মডিউল এনে রফতানি করছে। তদন্তের আওতা সম্প্রসারিত হয়েছে মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ছাড়াও ইন্দোনেশিয়া, লাওস ও ভারতের দিকে।
শুল্কের ধাক্কা
প্রথমে সাবেক প্রেসিডেন্ট বাইডেন দুই বছরের জন্য শুল্ক মওকুফ করেছিলেন। কিন্তু ২০২৪ সালের মাঝামাঝি মেয়াদ শেষ হওয়ার পর পরিস্থিতি বদলায়। ট্রাম্প প্রশাসন আবারও কঠোর পদক্ষেপ নেয়, যেখানে কাম্বোডিয়ার সৌরপণ্যের ওপর ৫৩৪ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৩৪০৩ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বসানো হয়।
এটি মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের তুলনায় অনেক বেশি। ফলে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। যেমন জিনটেক ফোটোভোল্টায়িক টেকনোলজি ও Solar Long PV Tech ইতিমধ্যে উৎপাদন বন্ধ করেছে। ভেনাস এনার্জি ও হোনেন সোলার এখনো রফতানি চালিয়ে যাচ্ছে, তবে তারাও টিকে থাকবে কি না অনিশ্চিত।

কর্মসংস্থান সংকট
হোনেন সোলারের এক ব্যবস্থাপক জানান, আগে ৩০০ কর্মী কাজ করত, এখন মাত্র চারজন আছেন। বিশাল শুল্কের কারণে ব্যবসা স্থবির হয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতি ও সমালোচনা
মার্কিন আইনজীবী ম্যাথিউ নাইসলি বলেন, ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্কনীতি আগের অর্থনৈতিক ধারণা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তিনি মনে করেন, আমদানি নির্ভরতা পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়। ইতিহাসের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ১৯৩০-এর দশকের স্মুট-হাওলি ট্যারিফই মহামন্দা বাড়িয়ে দিয়েছিল।
কাম্বোডিয়ার প্রতিক্রিয়া
মেংহৌত যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ অস্বীকার করেন যে তারা চীনা পণ্য পুনঃরফতানি করছে। তিনি জানান, ২০২৩ সালে মার্কিন কর্মকর্তারা কারখানা পরিদর্শন করেছেন এবং নথিপত্রও দেখেছেন।
তিনি বলেন, “আমরা এক হাজারেরও বেশি কর্মী দিয়ে উৎপাদন করেছি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আমাদের তদারকি করে। আমরা প্রতারণা করি না।”

বাণিজ্য যুদ্ধের শিকার
আগে কাম্বোডিয়া যুক্তরাষ্ট্রের জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্সের আওতায় শুল্কমুক্ত সুবিধা পেত। কিন্তু ২০২০ সালের পর থেকে তা আর নবায়ন হয়নি। এতে দেশটি নতুন পরিস্থিতিতে পড়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, চীনের উৎপাদন ঘুরিয়ে দেওয়ার ফলে কাম্বোডিয়াও এখন একই ঝুঁকির মুখে।
গবেষকরা বলছেন, এই শিল্প স্থানীয় দক্ষতা উন্নয়নের বদলে কেবল উৎপাদন সুরক্ষা দিচ্ছে। প্রযুক্তির গোপনীয়তা রাখায় স্থানীয় কর্মীরা উচ্চপদে উঠতে পারছেন না। এছাড়া কারখানাগুলো সহজে খোলা-বন্দ করা যায়, তাই দীর্ঘমেয়াদি শিল্প উন্নয়ন হচ্ছে না।
কর্মীদের অভিজ্ঞতা
মেংহৌত মনে করেন, সৌরশিল্প কর্মীদের ভালো বেতন ও প্রযুক্তি শেখার সুযোগ দিয়েছে। তার ভাষায়, “২০ বছর পোশাকশিল্পে কাজ করেছি, সেখানে শুধু কাপড়-সুতার দেখেছি। সৌরশিল্পে এসে নতুন কিছু শিখতে পেরেছি।”
অন্যদিকে এক ফল বিক্রেত্রী জানান, আগে তিনি একটি সৌর কারখানায় নার্স হিসেবে কাজ করতেন। যুক্তরাষ্ট্র অর্ডার বন্ধ করে দেওয়ায় কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বলেন, “যদি আবার সৌর উৎপাদন শুরু হয়, সবাই ফিরে আসবে। কারণ সেখানে ভালো বেতন আর ভালো ব্যবস্থাপক ছিল।”
কাম্বোডিয়ার সৌরশিল্প একসময় দ্রুত উত্থান ঘটালেও যুক্তরাষ্ট্র-চীন বাণিজ্যযুদ্ধের ধাক্কায় এখন টিকে থাকার লড়াই করছে। শুল্ক-সংকট না কাটলে এই শিল্পের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়বে, আর হাজারো কর্মীর জীবিকা আরও ঝুঁকির মুখে পড়বে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 




















