বেইজিংয়ে নতুন শক্তির প্রদর্শন
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং গত তিন দিন ধরে এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের স্বাগত জানিয়েছেন সাংহাই কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে। এবার তিনি ভিন্ন এক বার্তা দিতে যাচ্ছেন—বৃহস্পতিবার বেইজিংয়ের প্রধান সড়ক ‘অ্যাভিনিউ অব ইটারনাল পিস’-এ বৃহৎ সামরিক কুচকাওয়াজ। এখানে প্রদর্শিত হবে হাইপারসনিক অস্ত্র, পারমাণবিক সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র, পানির নিচের ড্রোন ও হাজারো সেনার পদযাত্রা।
শি-এর এই পদক্ষেপের মূল বার্তা স্পষ্ট—চীন বৈশ্বিক নিয়মকানুন নতুনভাবে সাজাতে চায় এবং পশ্চিমাদের চ্যালেঞ্জ জানাতে দ্বিধা করছে না।

“অশান্তির অক্ষ” একত্রিত
এবারের অতিথি তালিকায় রয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন ও ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান। প্রথমবারের মতো এই চার দেশের শীর্ষ নেতারা একই মঞ্চে একসাথে হচ্ছেন, যাদের নিয়ে পশ্চিমা কৌশলবিদরা বহুদিন ধরে সতর্ক করছেন যে তারা একটি “অশান্তির অক্ষ” গঠন করছে।
পশ্চিমাদের কাছে এটি উদ্বেগজনক দৃশ্য—কারণ রাশিয়াকে অস্ত্র ও সেনা দিয়ে সহায়তা করেছে ইরান ও উত্তর কোরিয়া, আর চীন রাশিয়ার যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতি পরিবর্তনে সুযোগ
যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর থেকে বৈশ্বিক বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হয়েছে, যা অনেক দেশকে অর্থনৈতিক চাপে ফেলেছে। এই অস্থিরতাকে সুযোগ হিসেবে দেখছেন শি জিনপিং। তার লক্ষ্য—পশ্চিমাদের নিয়মভিত্তিক বিশ্বব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানানো এবং চীনকে বিকল্প নেতৃত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা।
ইতিমধ্যেই কূটনৈতিক অঙ্গনে চীনের অবস্থান শক্তিশালী হচ্ছে। সম্মেলনের আড়ালে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও পুতিনের সঙ্গে শি-এর উষ্ণ আলাপচারিতা পশ্চিমাদের জন্য বিব্রতকর বার্তা।

এসসিও সম্মেলনে শি-এর বার্তা
রবিবার ও সোমবার এসসিও বৈঠকে শি বলেন, বিশ্ব অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলায় ভুগছে, আর চীন দায়িত্বশীল ও স্থিতিশীল শক্তি হিসেবে নেতৃত্ব দিতে প্রস্তুত। তিনি “শীতল যুদ্ধ মানসিকতা ও দমননীতি”র বিরোধিতা করার আহ্বান জানান এবং সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে শত শত মিলিয়ন ডলার অনুদানের প্রতিশ্রুতি দেন।
শি স্পষ্টভাবে বলেন, “কয়েকটি দেশের নিয়ম অন্যদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়।”
ভারতের অবস্থান ও মার্কিন চাপে প্রভাব
ভারত দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতা রেখেও সম্প্রতি সম্পর্ক টানাপোড়েনে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার তেল কেনার কারণে ভারতের ওপর ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক আরোপ করেছে। এর বিপরীতে মোদি শি ও পুতিনের সঙ্গে হাসিমুখে আলাপ করেছেন, যা বড় ধরনের বার্তা বহন করছে।
পশ্চিমাদের সমালোচনার জবাব
উত্তর কোরিয়া, রাশিয়া ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে চীনকে বারবার সমালোচনা করেছে পশ্চিমা দেশগুলো। এবার শি সেই সমালোচনার জবাব দিচ্ছেন, প্রমাণ করছেন যে চীনই ঠিক করবে কে আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে, পশ্চিমা দেশগুলো নয়।

বিশ্লেষকদের মতে, চার দেশের নেতারা একই জায়গায় উপস্থিত হওয়া একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত, যদিও এর আগে চতুর্পক্ষীয় সমন্বয়ের তেমন কোনো প্রমাণ ছিল না।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও প্রতীকী বার্তা
এবারের কুচকাওয়াজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির ৮০তম বার্ষিকীকে স্মরণ করছে। শি ও পুতিন সেই ইতিহাস টেনে আনছেন, যেন তারা যুদ্ধোত্তর আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রকৃত অভিভাবক। তাদের দৃষ্টিতে, ইউক্রেন যুদ্ধ বা উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক কর্মসূচির মূল কারণ পশ্চিমাদের নিরাপত্তা উদ্বেগ উপেক্ষা করা।
যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বর্ণনা ও চীনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা
শি জিনপিং এখন খোলাখুলিভাবে বলছেন যে পশ্চিমারা চীনের উত্থান ঠেকাতে চাইছে। তার কৌশল হলো—যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, পশ্চিমাদের ঐক্য দুর্বল করা এবং চীনকে বিশ্বে বিকল্প শক্তি হিসেবে দাঁড় করানো।
বেইজিংয়ের এই কুচকাওয়াজ শুধু সামরিক শক্তি প্রদর্শনের জন্য নয়, বরং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চীনের কূটনৈতিক অবস্থান মজবুত করার জন্য। শি জিনপিংয়ের বার্তা স্পষ্ট—চীন আর শুধুই আঞ্চলিক শক্তি নয়, বরং পশ্চিমা প্রভাবের বাইরে নতুন বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্র।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 

























