ঘটনাটির শুরু
ঢাকার এক ব্যস্ত বাজারে এক ভদ্রমহিলা বৃহস্পতিবার সকালে আসেন পেয়ারা কিনতে। বিক্রেতা প্রতি কেজির দাম চাইলেন ৯০ টাকা। নারী অবাক হয়ে বললেন, “কালকেই তো আমি ৫৫ টাকায় কিনেছি! আজ ৬০ টাকা দিই ।” কিন্তু বিক্রেতা মাথা নাড়লেন। তিনি জানালেন, তার ক্রয়মূল্যই এখন ৮০ টাকা, তাই এর নিচে বিক্রি করা সম্ভব নয়। দর-কষাকষির পরেও সমঝোতা হলো না। ওই ভদ্রমহিলা হতাশ মুখে বাজার ছেড়ে চলে গেলেন, হাতে ফল নয়—কেবল মনে চাপা অসহায়তা।
ক্রমবর্ধমান মূল্যস্ফীতি
এই ছোট্ট ঘটনাটি আজকের বাংলাদেশ অর্থনীতির বড় চিত্রকে তুলে ধরে। প্রতিদিন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বাড়ছে। গত সপ্তাহে যে ফল বা সবজি ৫০ টাকায় পাওয়া গেছে, আজ তার দাম ৮০ বা ৯০ টাকা। খুচরা বিক্রেতারাও বাধ্য হচ্ছেন বাড়তি দামে বিক্রি করতে, কারণ তাদের পাইকারি ক্রয়মূল্য বেড়েছে। এতে ভোক্তা এবং বিক্রেতা—দুজনেরই অসুবিধা তৈরি হচ্ছে।
সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা
অর্থনীতির বড় চ্যালেঞ্জ হলো সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার ক্রমশ পতন। স্থবির বেতন, আয়ের সীমাবদ্ধতা, আর বাড়তে থাকা মূল্যস্ফীতি মিলিয়ে মানুষ বাজারে গিয়ে অসহায় হয়ে পড়ছে। প্রতিদিনই তাদের খাদ্যতালিকা ছোট হচ্ছে। মাছ, মাংস, ফলমূল—এগুলো এখন অনেকের জন্য বিলাসী পণ্য হয়ে উঠেছে। একসময় যে মধ্যবিত্ত পরিবার সপ্তাহে একবার গরুর মাংস খেতে পারত, এখন মাসেও তা সম্ভব হচ্ছে না।
খাদ্যের সংকট ও দৈনন্দিন জীবন
খাদ্যের সংকট এখন শুধু নিম্নবিত্তের নয়, মধ্যবিত্তও একই ভোগান্তির মধ্যে পড়ছে। অনেকে ভরসা রাখছে ভর্তা, ডাল আর ভাতের ওপর। বাজারে গিয়ে প্রিয় ফল বা সবজি হাতে নিতে গিয়ে আবার তা রেখে আসতে হচ্ছে, কারণ দাম সামলানো যাচ্ছে না। ফলে খাদ্যতালিকার বৈচিত্র্য কমছে, পুষ্টিহীনতা বাড়ছে। শিশুদের জন্য ফলমূল কিনতে না পারার কষ্ট বাবা-মায়ের চোখে-মুখে প্রতিফলিত হচ্ছে।
অর্থনীতির দিকচিত্র
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অস্থিরতা, ডলারের দাম বৃদ্ধি, আমদানি নির্ভরতা, জ্বালানি সংকট এবং অভ্যন্তরীণ নীতিগত দুর্বলতা বাংলাদেশের বাজারকে আরও অস্থির করে তুলেছে। কৃষক ন্যায্যমূল্য না পেলেও মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণে ভোক্তা বেশি দামে কিনতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে কর্মসংস্থান না বাড়ায় মানুষের হাতে বাড়তি অর্থ আসছে না। ফলে সামগ্রিক অর্থনীতি যেন এক অচলাবস্থায় দিকে যাচ্ছে।
মানুষের মুখে প্রতিদিনের গল্প
পেয়ারা কিনতে না পারা সেই নারীর গল্প আজকের প্রতিটি পরিবারের বাস্তবতা। কেউ হয়তো ডিম না কিনে ডাল নিলেন, কেউ মাছ ছেড়ে শাক-সবজি বেছে নিলেন। কিন্তু সবার মুখে একটাই প্রশ্ন—“কোথায় যাচ্ছে আমাদের অর্থনীতি?”
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট আজ সাধারণ মানুষের জীবনে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ধরা পড়ছে বাজারে। প্রতিটি টাকার হিসাব করে চলতে হচ্ছে পরিবারগুলোকে। যে নারী পেয়ারা কিনতে পারেননি, তার চোখের হতাশা আসলে কোটি মানুষের অভিন্ন অনুভূতি। যদি দ্রুত কার্যকর নীতিগত পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা এবং দৈনন্দিন জীবনের ভারসাম্য আরও বিপর্যস্ত হবে।
বিস্তৃত বিশ্লেষণ ও প্রেক্ষাপট
বিশেষজ্ঞদের মতামত
অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমান বাজার অস্থিরতার মূল কারণ কয়েকটি। প্রথমত, ডলারের বিপরীতে টাকার মান অবমূল্যায়ন হয়েছে। ফলে আমদানি নির্ভর পণ্য যেমন তেল, ভোজ্যতেল, গম, ডাল—সবকিছুর দাম বেড়েছে। দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীণ সরবরাহ শৃঙ্খল দুর্বল হওয়ায় কৃষকের পণ্য ন্যায্য মূল্যে পৌঁছায় না। তৃতীয়ত, নীতিনির্ধারণী স্তরে সঠিক নিয়ন্ত্রণের অভাব দেখা দিয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন, দীর্ঘমেয়াদে এই সংকট চলতে থাকলে খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়বে।
কৃষকের বাস্তবতা
গ্রামের কৃষকরা অভিযোগ করছেন, তারা যে দামে ফসল বিক্রি করেন, তার সঙ্গে শহরের বাজারমূল্যের বিশাল পার্থক্য। ধরা যাক, এক কৃষক ৩০ টাকা কেজি দরে টমেটো বিক্রি করেছেন। কিন্তু সেই টমেটো ঢাকার বাজারে পৌঁছে ৮০ টাকা হয়ে যাচ্ছে। এতে কৃষক লাভ পাচ্ছেন না, আবার ভোক্তাও ন্যায্যমূল্যে কিনতে পারছেন না। মধ্যস্বত্বভোগীরা মুনাফার বড় অংশ হাতিয়ে নিচ্ছে।
পাইকারি বাজারের অস্থিরতা
পাইকারি বাজারেও এখন দাম নিয়ন্ত্রণহীন। আমদানিকারকরা ডলার সংকটের কারণে উচ্চ দামে পণ্য আনছেন। আবার অনেক সময় কৃত্রিম সংকট তৈরি করে বেশি দাম আদায় করা হচ্ছে। এ কারণে খুচরা বিক্রেতারা যেমন অসুবিধায় পড়ছেন, তেমনি সাধারণ মানুষও পড়ছেন মহাবিপাকে।
ভোক্তাদের অভিজ্ঞতা
ঢাকার মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিণীরা জানাচ্ছেন, তারা প্রতিদিন বাজারে গিয়ে নতুন এক দামের ধাক্কা খাচ্ছেন। অনেকে খাবারের তালিকা থেকে ফল বাদ দিয়েছেন। শিশুর জন্য দুধ, ফল, ডিম—এসব কিনতে এখন ভাবতে হচ্ছে বহুবার। এক মা বলেছেন, “বাচ্চার জন্য আপেল কিনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কেজি প্রতি ৪৯০ টাকা শুনে কিনতে পারলাম না।”
আন্তর্জাতিক প্রভাব
বিশ্ববাজারে জ্বালানি ও খাদ্যের দামের ওঠানামা বাংলাদেশের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে গমের দাম বেড়েছে, মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিরতার কারণে জ্বালানির দাম বাড়ছে। এসবের প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশের বাজারে।
সরকারের উদ্যোগ ও সীমাবদ্ধতা
সরকার টিসিবির মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কম দামে বিক্রির চেষ্টা করছে। তবে সরবরাহ সীমিত হওয়ায় সব পরিবার সে সুবিধা পাচ্ছে না। আবার বাজারে পর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ না থাকায় অনেক সময় কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়।
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো জনগণের ক্রয়ক্ষমতা ফিরিয়ে আনা। এর জন্য প্রয়োজন—
- • কর্মসংস্থান সৃষ্টি
- • উৎপাদন খরচ কমানো
- • কৃষকের জন্য ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা
- • বাজারে শক্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা
- • সামাজিক নিরাপত্তা জোরদার করা
চূড়ান্ত ভাবনা
পেয়ারা কিনতে না পারা সেই নারীর চোখে যে হতাশা, সেটিই বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকটের প্রতিচ্ছবি। এটি শুধু এক ব্যক্তির গল্প নয়, বরং কোটি মানুষের প্রতিদিনের জীবনসংগ্রাম। প্রতিটি বাজারে যাওয়া এখন তাদের জন্য পরীক্ষা, প্রতিটি সিদ্ধান্ত তাদের খাদ্যতালিকা ছোট করছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি যদি দ্রুত স্থিতিশীল না হয়, তবে মানুষের ভোগান্তি আরও বাড়বে, সামাজিক অস্থিরতাও বৃদ্ধি পাবে। তাই এখনই প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ, যাতে মানুষ আবার বাজারে গিয়ে অন্তত প্রয়োজনীয় খাবারগুলো কিনতে সক্ষম হয়।