দক্ষিণ চীনের উপকূলে বিশাল টারবাইনের উত্থান
দক্ষিণ চীনের ইয়াংজিয়াং উপকূলে সমুদ্রের বুকে দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল ডাবল হেড টারবাইন। স্টিলের জালের মতো কেবল আর উজ্জ্বল হলুদ রঙের তিনটি নোঙরের মাধ্যমে এটি সমুদ্রতলের সঙ্গে যুক্ত। ‘ওশানএক্স’ নামে পরিচিত এই নকশা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ভাসমান বায়ুকল, যা যেকোনো প্রচলিত টারবাইনের চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারে। এটি শুধু প্রযুক্তির সীমানা অতিক্রম করছে না, বরং চীনা সবুজ প্রযুক্তি শিল্পের উচ্চাভিলাষকেও প্রতিফলিত করছে।

নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে চীনের শীর্ষ অবস্থান
চীন বহু বছর ধরে সৌরশক্তি ও সমুদ্রের বুকে টারবাইন বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশ্বের নেতৃত্ব দিচ্ছে। এ বছর বিশ্বের মোট নতুন অফশোর টারবাইনের প্রায় তিন-চতুর্থাংশই চীন স্থাপন করবে। দেশটির জ্বালানি নিরাপত্তা সবসময় অগ্রাধিকার পায়, আর নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎয়ের মাধ্যমে তারা আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানোর চেষ্টা করছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর বিপরীত চিত্র
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে পরিস্থিতি একেবারেই ভিন্ন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু থেকেই বায়ুকলকে বিরোধিতা করেছেন, একে তিনি পাখি ও তিমির ঘাতক বলে অভিহিত করেন। ক্ষমতায় এসেই তিনি নতুন অফশোর প্রকল্প অনুমোদন বন্ধ করে দেন। এর ফলে ডেনমার্কের অরস্টেড নামের কোম্পানি বড় আঘাত পায়, তাদের শেয়ার মূল্য ধসে পড়ে। ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের আরও অনেক প্রতিষ্ঠান একইভাবে খরচ বৃদ্ধি, সুদের চাপ এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতায় হিমশিম খাচ্ছে।
জাপানে প্রকল্প বাতিল
সম্প্রতি মিতসুবিশি ঘোষণা দিয়েছে, তারা তিনটি অফশোর প্রকল্প থেকে সরে যাচ্ছে। সরবরাহ শৃঙ্খলে জটিলতা ও ব্যয় বৃদ্ধির কারণে ২০২১ সালে নেওয়া টেন্ডারের প্রকল্পগুলো আর সম্ভব নয় বলে জানানো হয়েছে।
চীনের সাফল্যের মূল কারণ
গ্লোবাল এনার্জি মনিটরের গবেষক ইউজিয়া হান জানান, চীনের সাফল্যের পেছনে আছে সহজ অর্থায়ন, সংহত সরবরাহ ব্যবস্থা, নীতিগত সহায়তা ও প্রযুক্তিগত উন্নতি। এসব মিলিয়ে দেশটির বাজার স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে দক্ষতা ও উদ্ভাবনের প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে, যা তাদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় এগিয়ে নিচ্ছে।

চীনা নির্মাতাদের আন্তর্জাতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা
গোল্ডউইন্ড ও মিং ইয়াংয়ের মতো কোম্পানিগুলো বিদেশি বাজারে প্রবেশ করছে। মিং ইয়াং তৈরি করেছে ওশানএক্স টারবাইন। বিশ্লেষক কোসিমো রিসের মতে, খরচে ব্যাপক সুবিধা ও পশ্চিমা কোম্পানিগুলোর সমস্যার কারণে চীনা নির্মাতারা বাজারের বড় অংশ দখল করবে।
ইউরোপে টারবাইনের চ্যালেঞ্জ
ইউরোপে একসময় অফশোর বায়ুকল জনপ্রিয় হলেও বর্তমানে ব্যয়ের কারণে প্রকল্পগুলো আকর্ষণ হারাচ্ছে। জার্মানির সাম্প্রতিক নিলামে কোনো বিডারই আগ্রহ দেখায়নি। তবে চীনা নির্মাতারা ইতোমধ্যেই কঠিন প্রতিযোগিতা ও সরকারি ভর্তুকি প্রত্যাহারের ধাক্কা সামলেছে। তারা বিশাল আকারের প্রকল্পে বিনিয়োগ করে বিদ্যুতের দাম অর্ধেকের নিচে নামিয়েছে, যা যুক্তরাজ্যের তুলনায় অনেক কম।
প্রযুক্তির বিশালত্ব ও সীমাবদ্ধতা
চীনা টারবাইনগুলো এত বিশাল যে এগুলো নির্মাণ প্রায় এক ধরনের অবকাঠামোগত প্রকল্প। উদাহরণ হিসেবে, ইয়াংজিয়াংয়ে মিং ইয়াংয়ের কারখানায় ১০০ মিটারের বেশি লম্বা ব্লেড তৈরি হচ্ছে। এখান থেকে উৎপাদিত প্রায় ১৫% পণ্য ইতালি ও অন্যান্য দেশে রপ্তানি হয়, যা বছর শেষে দ্বিগুণ হওয়ার আশা করা হচ্ছে।

গুয়াংদং প্রদেশে অফশোর বিদ্যুতের প্রসার
বর্তমানে ইয়াংজিয়াংয়ের টারবাইনগুলো মূলত গুয়াংদং প্রদেশের বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। প্রদেশটি ২০২৫ সালের মধ্যে ১৭ গিগাওয়াট অফশোর বিদ্যুৎ স্থাপনের লক্ষ্য নিয়েছে, যা চীন বাদে অন্য কোনো দেশ এখনো অর্জন করতে পারছে না। এখানে সমুদ্রতলের জটিল ভৌত গঠন বড় টারবাইন বসাতে সহায়ক হয়েছে।
বৈশ্বিক বাজারে অনিশ্চয়তা
যদিও ইতালির তারান্তো প্রকল্পে চীনা টারবাইন ব্যবহৃত হচ্ছে, তবে জার্মানির একটি প্রকল্প চুক্তি বাতিল করেছে জাতীয় নিরাপত্তা ও প্রতিযোগিতা নিয়ে উদ্বেগের কারণে। মিং ইয়াং জানিয়েছে, তারা ইউরোপীয় বাজারে কাজ চালিয়ে যাবে এবং স্থানীয় উৎপাদনের সম্ভাবনাও খতিয়ে দেখছে।

ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
মিং ইয়াংয়ের আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রেসিডেন্ট ঝাং চিইয়িং বলেছেন, ইউরোপীয় সরকার ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে বোঝাতে হবে যে চীনা কোম্পানিগুলো দীর্ঘমেয়াদে সেবা দিতে সক্ষম। স্থানীয় কর্মী নিয়োগ ও প্রযুক্তি ভাগাভাগির মাধ্যমে আস্থা অর্জন সম্ভব হবে। তার মতে, পরিচ্ছন্ন ও সস্তা অফশোর বিদ্যুৎ শেষ পর্যন্ত ইউরোপেও গ্রহণযোগ্য হবে, তবে এর পথে অযৌক্তিক বাধা না থাকে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















