০৬:১২ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫
এআই ভিডিও কমাতে ‘টোন ডাউন’ অপশন আনছে টিকটক রেকর্ড-নতুন ফল: চীনের জুনো ‘ঘোস্ট পার্টিকল’ ডিটেক্টরের অভাবনীয় সাফল্য ডেভনে আবার ফিরতে পারে বন্য বিড়াল: দুই বছরের গবেষণায় নতুন সম্ভাবনা প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩২৭) নন-প্রফিট কাঠামোতে যাচ্ছে মাষ্টডন, সিইও পদ ছাড়ছেন প্রতিষ্ঠাতা ইউজেন রখকো” ইউটিউবে রেকর্ড ভিউ, তবু ‘বেবি শার্ক’ নির্মাতার আয় সীমিত কেন” চীনের এআই দৌড়ে তীব্র প্রতিযোগিতা, লোকসানে কেঁপে উঠল বাইদু গোপন সসের নিরাপত্তায় নতুন জোর দিচ্ছে রেইজিং কেইন’স  সিডনিতে জমজমাট ২০২৫ এআরআইএ অ্যাওয়ার্ড, এগিয়ে নিনাজারাচি ও ডম ডোলা তাইওয়ানের স্যাটেলাইট যুগের সূচনা: স্পেসএক্স উৎক্ষেপণে বড় অগ্রগতি

সুন্দরবনের নদী ও মোহনায় শুধু টিকে আছে লবন পানির কুমির

বাংলাদেশের নদী ও জলাভূমি একসময় ছিল জীববৈচিত্র্যের বিশাল ভাণ্ডার। দেশজুড়ে ছোট-বড় নদী, খাল-বিল ও মোহনায় অগণিত জলজ প্রাণীর বসবাস ছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল কুমির। প্রাচীনকাল থেকে কুমির শুধু নদীর প্রাণীই নয়, মানুষের সংস্কৃতি, লোককথা ও জীবনের অংশ হয়ে থেকেছে। একসময় দেশের নানা প্রান্তের নদীতে কুমিরের দেখা মিললেও আজ তা সীমিত হয়ে এসেছে মূলত সুন্দরবনের নদী-নদীতে। বর্তমানে লবণাক্ত পানির কুমির বাংলাদেশের একমাত্র কার্যকর প্রজাতি হিসেবে টিকে আছে, যেখানে মিঠা পানির কুমির প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই প্রজাতির উপস্থিতি, সংকট ও সংরক্ষণ নিয়ে আলোচনা করাই এখানে মূল বিষয়।

লবণাক্ত পানির কুমির: বাংলাদেশের নদীর প্রধান প্রতিনিধি

লবণাক্ত পানির কুমির বা Crocodylus porosus বিশ্বের সবচেয়ে বড় কুমির প্রজাতি। বাংলাদেশে এদের প্রধান আবাস সুন্দরবনের নদী ও মোহনা। এরা লোনা ও মিঠা দুই ধরনের পানিতেই বেঁচে থাকতে পারে। সুন্দরবনের স্রোতস্বিনী নদী, শাখা খাল, এমনকি বঙ্গোপসাগরের মোহনাতেও এদের বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। এ কারণে স্থানীয় জেলেদের ভাষায় এদের “নদীর শাসক” বলা হয়।

এ প্রজাতির কুমিরের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৪ থেকে ৫ মিটার পর্যন্ত হয়, তবে বিরল ক্ষেত্রে এর চেয়েও বড় হতে পারে। পুরুষ কুমির স্ত্রী কুমিরের তুলনায় আকারে অনেক বড় হয়। এরা অত্যন্ত শক্তিশালী শিকারি এবং মাছ, হরিণ, এমনকি ছোট আকারের বন্যপ্রাণীও এদের খাদ্য তালিকায় থাকে। নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া মানুষের ওপরও এরা হামলা চালায়, যা সুন্দরবন এলাকার মানুষের কাছে আতঙ্কের বিষয়।

মিঠা পানির কুমির: ইতিহাসের স্মৃতি

অতীতে বাংলাদেশের বিভিন্ন নদী ও জলাশয়ে মিঠা পানির কুমির (Crocodylus palustris) পাওয়া যেত। লোককথায় শোনা যায়, পদ্মা ও যমুনার তীরবর্তী অঞ্চলেও এদের উপস্থিতি ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যায়, নদীর তীর ঘেঁষে মানুষের বসতি বেড়ে যায় এবং নির্বিচারে শিকারের কারণে এরা দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক পরিবেশে মিঠা পানির কুমিরের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। কেবল চিড়িয়াখানা বা সংরক্ষিত প্রজননকেন্দ্রে সীমিত আকারে এদের দেখা যায়।

তুলনামূলক প্রাচুর্য

আজকের বাস্তবতায় বাংলাদেশে নদী-নদীতে লবণাক্ত পানির কুমিরই সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় এদের উপস্থিতি চোখে পড়ে। অন্যদিকে মিঠা পানির কুমির প্রাকৃতিকভাবে প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। তাই বাংলাদেশের নদীগুলোয় প্রাচুর্যের বিচারে লবণাক্ত পানির কুমিরই এখন প্রধান প্রতিনিধি।

কুমিরের প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি

কুমিরের প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী কুমির নদীর ধারে বা বালুকাময় চর এলাকায় বাসা তৈরি করে ডিম পাড়ে। সাধারণত একটি স্ত্রী কুমির ২০ থেকে ৬০টি ডিম দিতে পারে। ডিম ফোটাতে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ দিন সময় লাগে। কুমির মায়ের তত্ত্বাবধানে বাচ্চাগুলো ডিম থেকে বের হয় এবং নদীতে বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু করে। সুন্দরবনে বন বিভাগ বিশেষ তদারকি করে কুমিরের ডিম ও বাচ্চা রক্ষায় কাজ করছে।

বাংলাদেশে কুমির সংরক্ষণে বিশেষ ভূমিকা রাখছে কক্সবাজারের ঢেমুশিয়ায় অবস্থিত প্রজনন কেন্দ্র। এখানে কুমিরের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো হয়, তাদের নিরাপদে বড় করা হয় এবং পরে প্রাকৃতিক আবাসস্থলে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে বন্য পরিবেশে কুমিরের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।

মানুষের সঙ্গে সংঘাত

সুন্দরবনের জেলেরা প্রতিদিন জীবিকার প্রয়োজনে নদীতে নামেন। মাছ ধরা, কাঁকড়া সংগ্রহ বা কাঠ কাটা—সব কাজই নদীর পানির সঙ্গে জড়িত। এ সময় কুমিরের মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। বহুবার জেলেদের ওপর কুমিরের হামলার ঘটনা ঘটেছে, যার কিছু প্রাণঘাতীও। স্থানীয় পত্রিকায় প্রায়ই শিরোনাম হয় “কুমিরের আক্রমণে জেলে নিহত”।

অন্যদিকে মানুষও কুমিরকে শিকার করে বা বিরক্ত করে। অনেক সময় ভয়ে বা ক্ষোভে মানুষ কুমির হত্যা করে। ফলে মানুষ ও কুমিরের দ্বন্দ্ব দিন দিন বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মানুষ-কুমির সংঘাত কমাতে হলে স্থানীয় জনগণকে সচেতন করতে হবে এবং বিকল্প জীবিকার সুযোগ তৈরি করতে হবে।

স্থানীয় মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি

সুন্দরবনের আশপাশের গ্রামগুলোতে এখনও নানা গল্প প্রচলিত আছে কুমির নিয়ে। কেউ কেউ কুমিরকে ভয়ঙ্কর হত্যাকারী হিসেবে দেখে, আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করে কুমির নদীর ভারসাম্য রক্ষা করে। বয়স্ক জেলেরা বলেন, “নদীতে কুমির আছে মানেই নদীটা এখনও বেঁচে আছে।” তবে অনেকে এটাও বলেন, “জীবন ও জীবিকার মধ্যে প্রতিদিন একটা বাজি ধরতে হয়, কারণ কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে নদীতে নামতে হয়।”

সংরক্ষণ কার্যক্রম

বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে কুমির সংরক্ষণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী কুমির শিকার পুরোপুরি নিষিদ্ধ। এ ছাড়া সুন্দরবনের কিছু এলাকায় কুমিরের প্রজননক্ষেত্র সুরক্ষিত করা হয়েছে।

কক্সবাজারের প্রজনন কেন্দ্র ছাড়াও আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন IUCN এবং বিশ্ব প্রকৃতি তহবিল (WWF) এ বিষয়ে সহযোগিতা করছে। কুমিরের বংশবৃদ্ধি, খাদ্য প্রাপ্যতা ও আবাসস্থল সুরক্ষিত করতে নানা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। তবে এখনও এটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

লবণাক্ত পানির কুমির শুধু বাংলাদেশেই নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও পাওয়া যায়। এ প্রজাতি সারা পৃথিবীর অন্যতম সফল কুমির প্রজাতি। তবে বিশ্বের অনেক দেশেই কুমির সংরক্ষণের সমস্যা একইরকম—মানুষের সঙ্গে সংঘাত, প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস, এবং অবৈধ শিকার। তাই বাংলাদেশে কুমির সংরক্ষণ কার্যক্রমকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা জরুরি।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

বাংলার লোককথায় কুমিরের বিশেষ স্থান আছে। নদীপথের যাত্রীদের কাছে কুমির ছিল ভয় ও বিস্ময়ের প্রতীক। প্রাচীনকালে নদীর ঘাটে কুমিরের উপদ্রব থেকে বাঁচতে বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজার প্রচলন ছিল। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে কুমিরকে ঘিরে নানা বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল। ইতিহাসবিদরা বলেন, কুমির নদীর সঙ্গে বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক সম্পর্কের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

যদিও বাংলাদেশে এখনও লবণাক্ত পানির কুমির সুন্দরবনের নদীতে টিকে আছে, তবে এর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। মানুষের ক্রমবর্ধমান বসতি, বনভূমি ধ্বংস, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত লবণাক্ততার বৃদ্ধি, এবং শিকার কুমিরের বেঁচে থাকার পথে বড় বাধা। যদি এখনই কার্যকর সংরক্ষণ উদ্যোগ না নেওয়া যায়, তাহলে আগামী কয়েক দশকে কুমিরও হয়তো ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাবে।

বাংলাদেশের নদীতে কুমিরের অস্তিত্ব এখন লবণাক্ত পানির কুমিরে সীমাবদ্ধ। মিঠা পানির কুমির ইতোমধ্যেই বিলুপ্তির পথে চলে গেছে। সুন্দরবনের নদী ও খালে লবণাক্ত পানির কুমির এখনও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে মানুষের সঙ্গে সংঘাত এবং আবাসস্থল ধ্বংস এদের জন্য বড় হুমকি। কুমির সংরক্ষণকে কেবল একটি প্রাণীর সুরক্ষাই নয়, বরং বাংলাদেশের নদী, বনভূমি ও সামগ্রিক পরিবেশ রক্ষার অংশ হিসেবেও দেখতে হবে।

জনপ্রিয় সংবাদ

এআই ভিডিও কমাতে ‘টোন ডাউন’ অপশন আনছে টিকটক

সুন্দরবনের নদী ও মোহনায় শুধু টিকে আছে লবন পানির কুমির

১১:০০:৩৩ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের নদী ও জলাভূমি একসময় ছিল জীববৈচিত্র্যের বিশাল ভাণ্ডার। দেশজুড়ে ছোট-বড় নদী, খাল-বিল ও মোহনায় অগণিত জলজ প্রাণীর বসবাস ছিল। এর মধ্যে অন্যতম ছিল কুমির। প্রাচীনকাল থেকে কুমির শুধু নদীর প্রাণীই নয়, মানুষের সংস্কৃতি, লোককথা ও জীবনের অংশ হয়ে থেকেছে। একসময় দেশের নানা প্রান্তের নদীতে কুমিরের দেখা মিললেও আজ তা সীমিত হয়ে এসেছে মূলত সুন্দরবনের নদী-নদীতে। বর্তমানে লবণাক্ত পানির কুমির বাংলাদেশের একমাত্র কার্যকর প্রজাতি হিসেবে টিকে আছে, যেখানে মিঠা পানির কুমির প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই প্রজাতির উপস্থিতি, সংকট ও সংরক্ষণ নিয়ে আলোচনা করাই এখানে মূল বিষয়।

লবণাক্ত পানির কুমির: বাংলাদেশের নদীর প্রধান প্রতিনিধি

লবণাক্ত পানির কুমির বা Crocodylus porosus বিশ্বের সবচেয়ে বড় কুমির প্রজাতি। বাংলাদেশে এদের প্রধান আবাস সুন্দরবনের নদী ও মোহনা। এরা লোনা ও মিঠা দুই ধরনের পানিতেই বেঁচে থাকতে পারে। সুন্দরবনের স্রোতস্বিনী নদী, শাখা খাল, এমনকি বঙ্গোপসাগরের মোহনাতেও এদের বিচরণ লক্ষ্য করা যায়। এ কারণে স্থানীয় জেলেদের ভাষায় এদের “নদীর শাসক” বলা হয়।

এ প্রজাতির কুমিরের দৈর্ঘ্য সাধারণত ৪ থেকে ৫ মিটার পর্যন্ত হয়, তবে বিরল ক্ষেত্রে এর চেয়েও বড় হতে পারে। পুরুষ কুমির স্ত্রী কুমিরের তুলনায় আকারে অনেক বড় হয়। এরা অত্যন্ত শক্তিশালী শিকারি এবং মাছ, হরিণ, এমনকি ছোট আকারের বন্যপ্রাণীও এদের খাদ্য তালিকায় থাকে। নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া মানুষের ওপরও এরা হামলা চালায়, যা সুন্দরবন এলাকার মানুষের কাছে আতঙ্কের বিষয়।

মিঠা পানির কুমির: ইতিহাসের স্মৃতি

অতীতে বাংলাদেশের বিভিন্ন নদী ও জলাশয়ে মিঠা পানির কুমির (Crocodylus palustris) পাওয়া যেত। লোককথায় শোনা যায়, পদ্মা ও যমুনার তীরবর্তী অঞ্চলেও এদের উপস্থিতি ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যায়, নদীর তীর ঘেঁষে মানুষের বসতি বেড়ে যায় এবং নির্বিচারে শিকারের কারণে এরা দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। বর্তমানে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক পরিবেশে মিঠা পানির কুমিরের অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। কেবল চিড়িয়াখানা বা সংরক্ষিত প্রজননকেন্দ্রে সীমিত আকারে এদের দেখা যায়।

তুলনামূলক প্রাচুর্য

আজকের বাস্তবতায় বাংলাদেশে নদী-নদীতে লবণাক্ত পানির কুমিরই সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। সুন্দরবনের বিস্তীর্ণ এলাকায় এদের উপস্থিতি চোখে পড়ে। অন্যদিকে মিঠা পানির কুমির প্রাকৃতিকভাবে প্রায় বিলীন হয়ে গেছে। তাই বাংলাদেশের নদীগুলোয় প্রাচুর্যের বিচারে লবণাক্ত পানির কুমিরই এখন প্রধান প্রতিনিধি।

কুমিরের প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি

কুমিরের প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী কুমির নদীর ধারে বা বালুকাময় চর এলাকায় বাসা তৈরি করে ডিম পাড়ে। সাধারণত একটি স্ত্রী কুমির ২০ থেকে ৬০টি ডিম দিতে পারে। ডিম ফোটাতে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ দিন সময় লাগে। কুমির মায়ের তত্ত্বাবধানে বাচ্চাগুলো ডিম থেকে বের হয় এবং নদীতে বেঁচে থাকার সংগ্রাম শুরু করে। সুন্দরবনে বন বিভাগ বিশেষ তদারকি করে কুমিরের ডিম ও বাচ্চা রক্ষায় কাজ করছে।

বাংলাদেশে কুমির সংরক্ষণে বিশেষ ভূমিকা রাখছে কক্সবাজারের ঢেমুশিয়ায় অবস্থিত প্রজনন কেন্দ্র। এখানে কুমিরের ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানো হয়, তাদের নিরাপদে বড় করা হয় এবং পরে প্রাকৃতিক আবাসস্থলে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে বন্য পরিবেশে কুমিরের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা চলছে।

মানুষের সঙ্গে সংঘাত

সুন্দরবনের জেলেরা প্রতিদিন জীবিকার প্রয়োজনে নদীতে নামেন। মাছ ধরা, কাঁকড়া সংগ্রহ বা কাঠ কাটা—সব কাজই নদীর পানির সঙ্গে জড়িত। এ সময় কুমিরের মুখোমুখি হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। বহুবার জেলেদের ওপর কুমিরের হামলার ঘটনা ঘটেছে, যার কিছু প্রাণঘাতীও। স্থানীয় পত্রিকায় প্রায়ই শিরোনাম হয় “কুমিরের আক্রমণে জেলে নিহত”।

অন্যদিকে মানুষও কুমিরকে শিকার করে বা বিরক্ত করে। অনেক সময় ভয়ে বা ক্ষোভে মানুষ কুমির হত্যা করে। ফলে মানুষ ও কুমিরের দ্বন্দ্ব দিন দিন বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মানুষ-কুমির সংঘাত কমাতে হলে স্থানীয় জনগণকে সচেতন করতে হবে এবং বিকল্প জীবিকার সুযোগ তৈরি করতে হবে।

স্থানীয় মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি

সুন্দরবনের আশপাশের গ্রামগুলোতে এখনও নানা গল্প প্রচলিত আছে কুমির নিয়ে। কেউ কেউ কুমিরকে ভয়ঙ্কর হত্যাকারী হিসেবে দেখে, আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করে কুমির নদীর ভারসাম্য রক্ষা করে। বয়স্ক জেলেরা বলেন, “নদীতে কুমির আছে মানেই নদীটা এখনও বেঁচে আছে।” তবে অনেকে এটাও বলেন, “জীবন ও জীবিকার মধ্যে প্রতিদিন একটা বাজি ধরতে হয়, কারণ কুমিরের সঙ্গে লড়াই করে নদীতে নামতে হয়।”

সংরক্ষণ কার্যক্রম

বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে কুমির সংরক্ষণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী কুমির শিকার পুরোপুরি নিষিদ্ধ। এ ছাড়া সুন্দরবনের কিছু এলাকায় কুমিরের প্রজননক্ষেত্র সুরক্ষিত করা হয়েছে।

কক্সবাজারের প্রজনন কেন্দ্র ছাড়াও আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন IUCN এবং বিশ্ব প্রকৃতি তহবিল (WWF) এ বিষয়ে সহযোগিতা করছে। কুমিরের বংশবৃদ্ধি, খাদ্য প্রাপ্যতা ও আবাসস্থল সুরক্ষিত করতে নানা প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। তবে এখনও এটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে আছে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

লবণাক্ত পানির কুমির শুধু বাংলাদেশেই নয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলেও পাওয়া যায়। এ প্রজাতি সারা পৃথিবীর অন্যতম সফল কুমির প্রজাতি। তবে বিশ্বের অনেক দেশেই কুমির সংরক্ষণের সমস্যা একইরকম—মানুষের সঙ্গে সংঘাত, প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস, এবং অবৈধ শিকার। তাই বাংলাদেশে কুমির সংরক্ষণ কার্যক্রমকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা জরুরি।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

বাংলার লোককথায় কুমিরের বিশেষ স্থান আছে। নদীপথের যাত্রীদের কাছে কুমির ছিল ভয় ও বিস্ময়ের প্রতীক। প্রাচীনকালে নদীর ঘাটে কুমিরের উপদ্রব থেকে বাঁচতে বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজার প্রচলন ছিল। এ ছাড়া চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলে কুমিরকে ঘিরে নানা বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠান প্রচলিত ছিল। ইতিহাসবিদরা বলেন, কুমির নদীর সঙ্গে বাংলার মানুষের সাংস্কৃতিক সম্পর্কের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।

ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

যদিও বাংলাদেশে এখনও লবণাক্ত পানির কুমির সুন্দরবনের নদীতে টিকে আছে, তবে এর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। মানুষের ক্রমবর্ধমান বসতি, বনভূমি ধ্বংস, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত লবণাক্ততার বৃদ্ধি, এবং শিকার কুমিরের বেঁচে থাকার পথে বড় বাধা। যদি এখনই কার্যকর সংরক্ষণ উদ্যোগ না নেওয়া যায়, তাহলে আগামী কয়েক দশকে কুমিরও হয়তো ইতিহাসের পাতায় হারিয়ে যাবে।

বাংলাদেশের নদীতে কুমিরের অস্তিত্ব এখন লবণাক্ত পানির কুমিরে সীমাবদ্ধ। মিঠা পানির কুমির ইতোমধ্যেই বিলুপ্তির পথে চলে গেছে। সুন্দরবনের নদী ও খালে লবণাক্ত পানির কুমির এখনও প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে মানুষের সঙ্গে সংঘাত এবং আবাসস্থল ধ্বংস এদের জন্য বড় হুমকি। কুমির সংরক্ষণকে কেবল একটি প্রাণীর সুরক্ষাই নয়, বরং বাংলাদেশের নদী, বনভূমি ও সামগ্রিক পরিবেশ রক্ষার অংশ হিসেবেও দেখতে হবে।