বাংলাদেশের ব্যাংক খাত গত এক দশকে ধারাবাহিকভাবে নানা সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। একদিকে ঋণখেলাপি বেড়ে চলেছে, অন্যদিকে তারল্য সংকট ও মূলধনের ঘাটতি তৈরি হয়েছে নিয়মিত। এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে সুশাসনের অভাব, রাজনৈতিক প্রভাব এবং আর্থিক অনিয়ম। ফলে ব্যাংক খাত শুধু দুর্বলই হয়নি, বরং অর্থনীতির সামগ্রিক স্থিতিশীলতাও হুমকির মুখে পড়েছে।
এই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার দুর্বল ব্যাংকগুলোর টিকে থাকা এবং খাতকে স্থিতিশীল করতে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে—দুর্বল ব্যাংকগুলোকে শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত বা মার্জার করা। আলোচনায় রয়েছে বিশেষ করে পাঁচটি ব্যাংককে একীভূত করার পরিকল্পনা। এই পদক্ষেপকে ঘিরে যেমন আশা জাগছে, তেমনি উদ্বেগও বাড়ছে।
কেন এই মার্জারের উদ্যোগ
বাংলাদেশে বর্তমানে বেসরকারি ও সরকারি মিলিয়ে প্রায় ৬০টির মতো ব্যাংক কার্যক্রম চালাচ্ছে। অথচ দেশের আর্থিক বাজারের আকার তুলনামূলক ছোট। ফলে বাজারে প্রতিযোগিতা যেমন বেড়েছে, তেমনি অনেক দুর্বল ব্যাংক নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারছে না।
- খেলাপি ঋণের বোঝা: বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে কয়েক লাখ কোটি টাকায়। এর বড় অংশ জমে আছে দুর্বল ব্যাংকগুলোর ঘাড়ে।
- মূলধনের ঘাটতি: অনেক ব্যাংকই মূলধনের ন্যূনতম মানদণ্ড পূরণ করতে পারছে না। ফলে আন্তর্জাতিক মানের ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে তাল মেলানো কঠিন হয়ে পড়ছে।
- তারল্য সংকট: নিয়মিত গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে বা নতুন ঋণ দিতে গিয়ে কিছু ব্যাংক সমস্যায় পড়ছে। এটি পুরো খাতের প্রতি গ্রাহক আস্থা ক্ষুণ্ন করছে।
এই অবস্থায় শক্তিশালী ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংক একীভূত করলে অন্তত টিকে থাকার মতো অবস্থায় আসবে—এমনটাই সরকারের প্রত্যাশা।
ইতিবাচক দিক
১. দুর্বল ব্যাংকের চাপ কমানো
মার্জারের ফলে দীর্ঘদিন ধরে খারাপ ঋণ ও মূলধনের ঘাটতিতে ভোগা ব্যাংকগুলো কিছুটা হলেও স্বস্তি পেতে পারে। শক্তিশালী ব্যাংকের অধীনে গেলে তাদের সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণে শৃঙ্খলা ফেরানোর সুযোগ তৈরি হবে।
২. স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা
শক্তিশালী ব্যাংকের আর্থিক সক্ষমতা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং প্রযুক্তি অবকাঠামো দুর্বল ব্যাংকের গ্রাহকদের জন্য নতুন সুযোগ তৈরি করতে পারে। এতে খাতের ওপর চাপ কিছুটা কমবে এবং দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতা ফেরার সম্ভাবনা বাড়বে।
৩. সংস্কারের সুযোগ
মার্জার প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিনের অনিয়ম, প্রভাবশালী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ এবং ঋণ প্রদানের অনৈতিক চর্চাগুলো চিহ্নিত ও সংস্কার করা সম্ভব হতে পারে। এটি ব্যাংক খাতে কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের একটি নতুন জানালা খুলতে পারে।
নেতিবাচক দিক
১. ভালো ব্যাংকের ঝুঁকি
যেসব ব্যাংক দীর্ঘ সময় ধরে নিয়ম মেনে, পরিশ্রম করে নিজেদের অবস্থান শক্ত করেছে, তাদের কাঁধে দুর্বল ব্যাংকের দায় চাপানো হলে বিপদে পড়ার ঝুঁকি তৈরি হবে। দুর্বল ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ও আর্থিক অনিয়ম ভালো ব্যাংকের স্থিতিশীলতাও নষ্ট করতে পারে।
২. সুশাসনের অভাব
মার্জার প্রক্রিয়া কতটা স্বচ্ছ হবে, তা নিয়েই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। আশঙ্কা রয়েছে, যেসব ব্যাংকের মালিকানায় রাজনৈতিক বা প্রভাবশালী মহলের সংশ্লিষ্টতা আছে, তারা হয়তো এ প্রক্রিয়ার বাইরে থেকে যাবে। এতে প্রকৃত সংস্কার না হয়ে নির্বাচিত কিছু ব্যাংকের ওপর চাপ তৈরি হবে।
৩. অতীতের ব্যর্থ অভিজ্ঞতা
বাংলাদেশে এর আগে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের একীভূতকরণ হলেও সেগুলো থেকে ইতিবাচক ফল আসেনি। বরং নতুন প্রতিষ্ঠানের ওপর খারাপ ঋণের বোঝা বেড়েছে, এবং তারা কিছুদিনের মধ্যেই সমস্যায় পড়েছে। একই ভুল পুনরাবৃত্তির শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
৪. দায় জনগণের ওপর চাপানো
সবচেয়ে বড় আশঙ্কা হলো—শেষ পর্যন্ত দুর্বল ব্যাংকের দায়-দেনা জনগণের কাঁধে চাপানো হবে। সাধারণ আমানতকারী ও গ্রাহকের অর্থ দিয়ে দুর্বল ব্যাংককে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা হলে এতে ব্যাংক খাতের প্রতি আস্থা আরও কমে যেতে পারে।
৫. গ্রাহকের উদ্বেগ
মার্জার প্রক্রিয়ার সময় সাধারণ গ্রাহক সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্ত হন। তাদের আমানত, ঋণ বা সেবার কী হবে—তা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকে। অনেক সময় আতঙ্কে গ্রাহকরা টাকা তুলে নিতে চাইলে তা খাতের স্থিতিশীলতাকে আরও নড়বড়ে করে দেয়।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ একমাত্র দেশ নয় যেখানে ব্যাংক মার্জারের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। উন্নত বিশ্বে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে, আর্থিক সংকট কাটাতে ব্যাংক মার্জার অনেকবার হয়েছে। ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার সময় একাধিক বড় ব্যাংক একীভূত হয়েছিল। ভারতেও বিগত দশকে সরকারি ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ফলে বাংলাদেশের সিদ্ধান্তকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট থেকে বিচ্ছিন্ন বলা যাবে না। তবে প্রশ্ন থেকে যায়—আমাদের দেশের দুর্বল নিয়ন্ত্রক কাঠামো ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে এ প্রক্রিয়া কতটা সফল হবে।
করণীয়
১. স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা
কোন ব্যাংক কেন মার্জারে যাচ্ছে, প্রক্রিয়াটি কীভাবে সম্পন্ন হবে—এর সব তথ্য জনগণের সামনে খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করতে হবে।
২. অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন
খেলাপি ঋণ ও খারাপ সম্পদ আলাদা করে পরিচালনার জন্য একটি বিশেষ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি গঠন করা জরুরি। এতে ভালো ব্যাংকগুলো অপ্রয়োজনীয় বোঝা বহন করতে বাধ্য হবে না।
৩. সময় ও প্রস্তুতি
তড়িঘড়ি করে মার্জার শুরু করলে ঝুঁকি বাড়বে। তাই আগে নীতি, কাঠামো, মানবসম্পদ ও প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি নিশ্চিত করতে হবে। পরে ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন জরুরি।
৪. গ্রাহক সুরক্ষা
গ্রাহকের আমানত ও সেবার স্বার্থ যাতে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। এজন্য গ্রাহকবান্ধব নীতিমালা প্রণয়ন অপরিহার্য।
৫. দায়বদ্ধতা নিরূপণ
দুর্বল ব্যাংকের অনিয়ম যারা করেছে, তাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। দায় চাপানো যাবে না শুধু সাধারণ জনগণের ওপর।
বাংলাদেশের ব্যাংক খাত দীর্ঘদিন ধরে নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। পাঁচটি ব্যাংকের মার্জারের উদ্যোগ যদি পরিকল্পিত, স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিমূলক হয়, তবে এটি খাতের জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলতে পারে। তবে বিপরীতে যদি প্রক্রিয়ায় সুশাসনের অভাব থাকে, প্রভাবশালীরা সুবিধা নেয় এবং জনগণের অর্থ দিয়ে দুর্বল ব্যাংক বাঁচানোর চেষ্টা হয়, তবে এটি উল্টো নতুন সংকট তৈরি করতে পারে।
এখন সময় এসেছে, দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে ব্যাংক খাতকে পুনর্গঠনের। শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণ কাঠামো, রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও গ্রাহকের আস্থা ফিরিয়ে আনার মাধ্যমে এই উদ্যোগকে সফল করা সম্ভব। অন্যথায়, পাঁচ ব্যাংকের মার্জার আরেকটি ব্যর্থ পরীক্ষার নাম হয়ে যাবে।