ডিকেন্স পড়তে হিমশিম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
একটি গবেষণা শুরু হয় সহজভাবে। আমেরিকার দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাহিত্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাস ব্লীক হাউস-এর প্রথম কয়েকটি অনুচ্ছেদ পড়তে দেওয়া হয়। তারপর সেটি ব্যাখ্যা করতে বলা হয়। কিন্তু কাজটি তারা একেবারেই সহজ মনে করতে পারেনি।
শিক্ষার্থীরা আইনি শব্দের জটিলতায় হারিয়ে যায়, রূপক অর্থ বুঝতে ব্যর্থ হয়। এমনকি সাধারণ শব্দের অর্থও তারা ধরতে পারেনি। এক শিক্ষার্থী ভেবেছিল “whiskers” মানে নাকি ঘরে কোনো প্রাণী—“হয়তো বিড়াল?” অর্থাৎ যারা সাহিত্য পড়ছে, তাদের অনেকেই প্রকৃতপক্ষে মৌলিক পড়াশোনার দক্ষতাই হারাচ্ছে।

বিশ্বজুড়ে পড়ার হার কমছে
বিভিন্ন গবেষণায় একই চিত্র পাওয়া যাচ্ছে। প্রাপ্তবয়স্করা কম পড়ছেন। শিশুরা কম পড়ছে। কিশোররা সবচেয়ে কম পড়ছে। ছোটদের পড়িয়ে শোনানোর অভ্যাসও দ্রুত কমছে। ধনী-গরিব সবার মধ্যেই এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
আমেরিকায় আনন্দের জন্য বই পড়ার হার গত ২০ বছরে দুই-পঞ্চমাংশ কমেছে। ব্রিটেনে ইউগভ জরিপে দেখা গেছে, ২০২৪ সালে ৪০ শতাংশ মানুষ কোনো বই পড়েনি বা শোনেনি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বেটের মতে, শিক্ষার্থীরা “তিন সপ্তাহে একটি উপন্যাসও শেষ করতে হিমশিম খায়।”
শুধু পড়ার হার নয়, পড়ার ধরণও বদলাচ্ছে
ইতিহাসে সব যুগেই পড়ার হ্রাস নিয়ে অভিযোগ শোনা গেছে। তবে এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। মানুষ কেবল কম পড়ছে না, বরং পাঠ্যপুস্তক ও জনপ্রিয় বইয়ের গঠনও বদলে গেছে। নিউইয়র্ক টাইমস বেস্টসেলার বইয়ের শত শত লেখার বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ১৯৩০-এর দশক থেকে বাক্যের দৈর্ঘ্য এক-তৃতীয়াংশ কমেছে।
জন রাসকিনের ভিক্টোরিয়ান বেস্টসেলার মডার্ন পেইন্টারস-এর প্রথম বাক্য ১৫৩ শব্দের। কিন্তু আজকের আমাজনের বেস্টসেলার লেট দেম থিওরাইজ বইয়ের প্রথম বাক্য মাত্র ১৯ শব্দের।

স্মার্টফোন দায়ী, নাকি আগ্রহ হারানো?
অনেকে বলছেন স্মার্টফোনের কারণে পড়ার অভ্যাস কমছে। তবে প্রাচীনকাল থেকেই বড় বই পড়াকে অনেকেই বিরক্তিকর মনে করত। প্রমাণ পাওয়া যায় প্রাচীন গ্রিক কবি ক্যালিম্যাকাস বা মধ্যযুগীয় সন্ন্যাসীদের লেখায়।
আসলে সমস্যা শুধু বিভ্রান্তি নয়, বরং পড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহই হ্রাস পাচ্ছে। ভিক্টোরিয়ান যুগে রাখালেরা নিজেদের মধ্যে বই ঘুরিয়ে পড়ত, শ্রমিকরা কষ্ট করে বই কিনত। সেই পড়ার আগ্রহ থেকে অনেকেই সমাজের শীর্ষে উঠে এসেছিল। যেমন র্যামসে ম্যাকডোনাল্ড, যিনি পরে ব্রিটেনের প্রথম লেবার প্রধানমন্ত্রী হন। আজ বই অনেক সস্তা, অনলাইনে বিনামূল্যে পাওয়া যায়, তবু পড়ার হার কমছেই।
শিক্ষকদের হতাশা
প্রফেসর রোজ একসময় ব্লীক হাউস পড়াতেন। এখন আর সাহস পান না। বিশ্ববিদ্যালয়ের চাপ আছে কম পড়াশোনা দিতে, আবার শিক্ষার্থীরা পড়তেও চায় না। জরিপে তরুণেরা পড়াশোনাকে “বিরক্তিকর” বা “বাধ্যতামূলক কাজ” বলে মনে করে।

রাজনীতিতে প্রভাব
প্রশ্ন হচ্ছে—এতে কার কী আসে যায়? কিন্তু পড়াশোনার অবক্ষয়ের প্রভাব শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সীমিত নয়। ইতিহাস বলে, পড়াশোনা রাজনৈতিক উন্নতির সঙ্গেও যুক্ত। প্রাচীন এথেন্সে নাগরিকেরা পড়তে-লিখতে জানত বলেই ‘অস্ট্রাসিজম’-এর মতো গণতান্ত্রিক প্রথা চালু হয়েছিল।
আজকের দিনে বিপরীত চিত্র। ব্রিটিশ সংসদের বক্তৃতা গত দশ বছরে এক-তৃতীয়াংশ ছোট হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্টদের উদ্বোধনী ভাষণের বিশ্লেষণেও একই প্রবণতা দেখা গেছে। জর্জ ওয়াশিংটনের ভাষণ ছিল স্নাতকোত্তর স্তরের জটিলতায়, আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষণ হাই স্কুল পর্যায়ের সরলতায় নেমে এসেছে।

সহজ লেখা বনাম চিন্তার সীমাবদ্ধতা
সহজ লেখা অনেক সময় ভালো, তবে জটিল লেখা পড়ার ক্ষমতা হারালে জটিল চিন্তাধারাও দুর্বল হয়ে পড়ে। অধ্যাপক বেটের মতে, এর ফলে মানুষ বৈপরীত্য ও সূক্ষ্মতা বোঝার ক্ষমতাও হারাবে। আজকের যুগে বার্তাগুলো সীমিত হয়ে পড়েছে ২৮০ অক্ষরে। অথচ ডিকেন্সের ব্লীক হাউস ছিল প্রায় ১৯ লাখ অক্ষরের।
সামাজিক গতিশীলতা ও আনন্দের ক্ষতি
পড়াশোনার মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিজেদের অবস্থান উন্নত করেছে। এটি ছিল সমতার এক শক্তিশালী হাতিয়ার। ধনী-গরিব নির্বিশেষে যে কেউ বই পড়তে পারত, এবং নিজের চিন্তার জগৎ প্রসারিত করতে পারত। আজ তা কমে যাওয়ায় সামাজিক অগ্রগতিও বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
কেবল তা-ই নয়, পড়া আসলে জীবনের অন্যতম আনন্দও বটে। ডিকেন্সের গ্রেট এক্সপেকটেশন্স-এর লোহার কারিগর জো যেমন বলেছিলেন, “একটা ভালো বই আর আগুনের পাশে বসার জায়গা চাই, তার চেয়ে ভালো কিছু চাই না।” যদি মানুষ এ আনন্দ ভুলে যায়, তবে সত্যিই পৃথিবী অন্ধকার হয়ে উঠবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















