বাংলাদেশ প্রকৃতির দানশীলতায় ভরপুর একটি দেশ। নদীমাতৃক এই ভূখণ্ডে একদিকে আছে সবুজের সমারোহ, অন্যদিকে আছে নীল জলের অপার বিস্তার। কিন্তু প্রকৃতির অদ্ভুত সব সৌন্দর্যের মাঝেও কিছু স্থান রয়েছে, যেগুলো এখনো পর্যাপ্ত পরিচিত নয়, অথচ সৌন্দর্য, জীববৈচিত্র্য ও ভৌগোলিক গুরুত্বে তুলনাহীন। এমনই একটি বিস্ময় হলো নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত নিঝুম দ্বীপ।
বঙ্গোপসাগরের কোলে জেগে ওঠা এই দ্বীপকে অনেকেই বলেন “বাংলাদেশের ছোট সুন্দরবন”। এখানে আছে কেওড়ার ঘন জঙ্গল, হাজারো চিত্রা হরিণের পাল, অতিথি পাখির সমারোহ এবং সমুদ্রের বুকে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের অপূর্ব দৃশ্য। কিন্তু নিঝুম দ্বীপ কেবল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার নয়, এটি মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম, পরিবেশগত ভারসাম্য ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনারও প্রতীক।
ভৌগোলিক অবস্থান ও জন্মকথা
নিঝুম দ্বীপ হাতিয়া উপজেলার দক্ষিণ-পূর্বাংশে, বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত। ১৯৫০-এর দশকের দিকে পলি জমে ভূমি তৈরি হতে শুরু করে। প্রথমদিকে জনবসতিহীন হলেও ১৯৭০-এর দশকের পর জেলে ও কৃষক পরিবার এখানে বসতি গড়ে তোলে। আজ এর আয়তন প্রায় ১৪ হাজার একর। দ্বীপটি এখনও জোয়ার-ভাটা ও ভাঙনের কারণে পরিবর্তনশীল, তাই একে প্রকৃতির জীবন্ত মানচিত্র বলা যায়।
ইতিহাস ও নামকরণ
শুরুর দিকে দ্বীপটির কোনো নির্দিষ্ট নাম ছিল না। স্থানীয় মানুষ একে কখনও “চর” আবার কখনও “হাতিয়ার দক্ষিণ চরের জমি” বলে ডাকত। পরবর্তীতে ১৯৭০-এর দশকে বন বিভাগ এখানে ব্যাপকভাবে কেওড়া ও গেওয়া গাছ লাগানো শুরু করে। ধীরে ধীরে দ্বীপটি সবুজে ঘেরা ও নীরব পরিবেশে পরিণত হয়। এজন্যই এর নামকরণ করা হয় “নিঝুম দ্বীপ”—অর্থাৎ, এক নীরব-শান্ত দ্বীপ।

সবুজ বনভূমি
১৯৭০-এর পর বন বিভাগ এখানে কেওড়া, গেওয়া, গোলপাটা ও বাইন গাছ লাগানো শুরু করে। বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার একর বনাঞ্চল দ্বীপকে ঘিরে রেখেছে। এই বন শুধু সৌন্দর্য নয়, বরং ঝড়-জলোচ্ছ্বাস থেকে দ্বীপকে আংশিক সুরক্ষা দেয়। কেওড়ার জঙ্গল পাখি, প্রাণী ও কীটপতঙ্গের জন্য নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করেছে।
এই বনের গভীরে গেলে শোনা যায় পাখির ডাক, দেখা যায় বুনো হরিণের পাল ছুটে বেড়াচ্ছে। দ্বীপে ভ্রমণকারীদের কাছে কেওড়ার বন যেন অন্য এক পৃথিবী—যেখানে প্রকৃতি ও বন্যপ্রাণী মিলেমিশে আছে এক অদ্ভুত সুষমায়।
জীববৈচিত্র্যের ভাণ্ডার
নিঝুম দ্বীপ জীববৈচিত্র্যের এক অপূর্ব কেন্দ্র।
- হরিণের স্বর্গ:এখানে প্রায় ৩-৪ হাজার চিত্রা হরিণ বসবাস করে। দ্বীপে গেলে খোলা মাঠে বা বনের ভেতর ছোট-বড় পাল দেখা যায়। এটি বাংলাদেশের আর কোথাও এমন সহজে দেখা যায় না।
- অতিথি পাখি:শীতকালে হাজার হাজার পরিযায়ী পাখি সাইবেরিয়া, চীন ও উত্তর মেরু থেকে উড়ে আসে। রাজহাঁস, গাঙচিল, শামুকখোল, বালি হাঁস দ্বীপকে রূপকথার মতো সাজিয়ে তোলে। সকালে সূর্য ওঠার সময় আকাশ ভরে যায় পাখির ঝাঁকে, যা এক অপূর্ব দৃশ্য।
- অন্যান্য প্রাণী:শিয়াল, বানর, বন্য শুকর, গুইসাপ, সাপ এবং নানা প্রজাতির কচ্ছপ ও সামুদ্রিক প্রাণীও এখানে দেখা যায়। এদের মধ্যে অনেকেই পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
- সামুদ্রিক সম্পদ:বঙ্গোপসাগরের ইলিশ, চিংড়ি, কাঁকড়া ও ঝিনুক দ্বীপের মানুষকে জীবিকা দেয়। একইসঙ্গে দেশের অর্থনীতিতেও অবদান রাখে।

মানুষের জীবন ও সংগ্রাম
দ্বীপে প্রায় ৩০ হাজার মানুষ বসবাস করে। তাদের জীবন নির্ভর করে মূলত মাছ ধরা ও কৃষির ওপর।
- জেলেরা সাগরে জীবন বাজি রেখে মাছ ধরে।
- কৃষকরা লবণাক্ত মাটিতে ধান,ডাল ও সবজি চাষ করে।
- নারীরা পরিবার সামলানোর পাশাপাশি চিংড়ি চাষ ও বনজ সম্পদ সংগ্রহে অংশ নেয়।
- ঘূর্ণিঝড়,জলোচ্ছ্বাস ও নদীভাঙন তাদের জীবনের নিত্যসঙ্গী হলেও তারা দ্বীপ ছেড়ে যেতে চায় না।
এখানকার মানুষ খুব সহজসরল। বিদ্যুৎ, চিকিৎসা ও শিক্ষার অভাব সত্ত্বেও তারা পরস্পরের সহযোগিতায় টিকে আছে। তাদের জীবন নিঝুম দ্বীপের মতোই—কষ্টের মাঝে নীরব, কিন্তু টিকে থাকার অদম্য শক্তিতে ভরা।
পর্যটনের স্বর্গরাজ্য
নিঝুম দ্বীপ এখন পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
- কেওড়ার ঘন জঙ্গল ভ্রমণকারীদের মুগ্ধ করে।
- হরিণের পাল কাছে থেকে দেখা এক বিরল অভিজ্ঞতা।
- অতিথি পাখির ঝাঁক,সমুদ্রের সৈকত ও সূর্যাস্তের দৃশ্য এখানে অনন্য।
- শান্ত ও নিরিবিলি পরিবেশ শহরের কোলাহল থেকে মুক্তির স্বর্গরাজ্য মনে হয়।
তবে পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকায় পর্যটকরা অনেক সময় সমস্যায় পড়েন। নৌযান চলাচল অনিরাপদ, থাকার জায়গার অভাব, চিকিৎসা সুবিধা সীমিত—এসব কারণে পর্যটন শিল্প এখনও পূর্ণতা পায়নি।

পরিবেশগত গুরুত্ব
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আলী বলেন:
“নিঝুম দ্বীপ কেবল একটি পর্যটনকেন্দ্র নয়; এটি বাংলাদেশের জলবায়ু ও পরিবেশ সুরক্ষার একটি শক্তিশালী দুর্গ। এখানে যে বনভূমি রয়েছে, তা ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি অনেকটা কমিয়ে দেয়।”
আসলে এই দ্বীপ শুধু সৌন্দর্যের নয়, বরং একটি জীবন্ত ল্যাবরেটরি। জীববিজ্ঞানী ও পরিবেশ গবেষকদের কাছে নিঝুম দ্বীপ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। এখানকার ম্যানগ্রোভ বন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমাতে বড় ভূমিকা রাখে।
সংকট ও চ্যালেঞ্জ
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ:ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে ভূমি ক্ষয় হচ্ছে।
- ভাঙন ও ক্ষয়:প্রতিবছর শত শত একর জমি নদীভাঙনে হারিয়ে যাচ্ছে।
- অবকাঠামোর অভাব:পর্যটকদের থাকার উপযুক্ত হোটেল-মোটেল নেই। বিদ্যুৎ ও চিকিৎসা সেবার সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
- মানবসৃষ্ট চাপ:গাছ কাটার প্রবণতা, অতিরিক্ত মাছ ধরা, প্রাণী শিকার পরিবেশের জন্য হুমকি।
এই সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান না করলে নিঝুম দ্বীপের জীববৈচিত্র্য মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
সরকারের পদক্ষেপ
বাংলাদেশ সরকার ২০০১ সালে নিঝুম দ্বীপকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করে। বন বিভাগ বন সংরক্ষণ, হরিণ রক্ষা এবং পর্যটন ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের উদ্যোগ নিয়েছে। তবে বাস্তবে কার্যকারিতা এখনো সীমিত। পর্যটকরা প্রায়ই অভিযোগ করেন—তথ্যকেন্দ্র, নিরাপদ নৌযান ও থাকার জায়গার অভাব।
গবেষণা ও শিক্ষার ক্ষেত্র
নিঝুম দ্বীপ জীববিজ্ঞানী ও গবেষকদের জন্য এক অসাধারণ ক্ষেত্র। জীববৈচিত্র্য, ইকোসিস্টেম, ম্যানগ্রোভ বন ও পরিযায়ী পাখি নিয়ে নিয়মিত গবেষণা চলছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রায়ই এখানে গবেষণা ভ্রমণে আসেন।

উন্নয়নের সম্ভাবনা
পর্যটন বিশেষজ্ঞ ড. সেলিম রেজা বলেন:
“যদি সঠিকভাবে পরিকল্পনা করা যায়, নিঝুম দ্বীপ ইকো-ট্যুরিজমের আন্তর্জাতিক মানচিত্রে স্থান পেতে পারে। প্রয়োজন পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো ও স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ।”
ইকো-ট্যুরিজম এখানে শুধু আয় নয়, বরং স্থানীয় জনগণের জীবিকা ও পরিবেশ সংরক্ষণের সমন্বিত মডেল হতে পারে।
ভবিষ্যতের জন্য করণীয়
বন সংরক্ষণ ও গাছ কাটা বন্ধ করা।
পরিবেশবান্ধব পর্যটন অবকাঠামো নির্মাণ।
স্থানীয় জনগণকে প্রশিক্ষণ দিয়ে পর্যটন ব্যবসায় যুক্ত করা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় টেকসই বাঁধ নির্মাণ।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিঝুম দ্বীপকে প্রচার করা।
প্রকৃতির লুকানো স্বর্গ নিঝুম দ্বীপ প্রকৃতির এক অনন্য উপহার। এখানে সমুদ্র, বন, হরিণ, অতিথি পাখি ও মানুষের সংগ্রামী জীবন মিলেমিশে এক বিস্ময়কর জগৎ তৈরি করেছে। এটি যেমন বাংলাদেশের জন্য একটি প্রাকৃতিক সম্পদ, তেমনি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটনকেন্দ্র হওয়ার যোগ্য। তবে প্রকৃতির এই বিস্ময় রক্ষায় অবিলম্বে কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















