দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর নির্বাচন, কিন্তু আস্থাহীনতার ছাপ
বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসে ২০২৫ সালকে গুরুত্বপূর্ণ মোড় বলা যায়। কারণ একই বছরে অনুষ্ঠিত হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (জাকসু) নির্বাচন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন। দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নির্বাচন ঘিরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যাপক প্রত্যাশা থাকলেও ফলাফল ও পরিস্থিতি দেখিয়ে দিল ছাত্ররাজনীতির পুরোনো অসুখগুলো এখনো দূর হয়নি।
জাকসু: ৩৩ বছর পর ভোট, কিন্তু কারচুপির অভিযোগে বর্জন
তিন দশকের বেশি সময় পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হলো কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন। শিক্ষার্থীরা ভেবেছিল, এ ভোট হবে একটি গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণ। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন।
জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল (জেচডি) সমর্থিত প্যানেল অভিযোগ তোলে যে ইসলামী ছাত্রশিবিরপন্থী শিক্ষার্থীরা ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করে একাধিকবার ভোট দিয়েছে। নারী শিক্ষার্থীরাও পুনঃপুন ভোট দিয়েছে বলে তাদের দাবি। দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে জেচডি সমর্থিত প্যানেল আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয়।
ভোট শুরুর সময় উৎসবমুখর পরিবেশ থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে পুরো ক্যাম্পাসে। ফলে শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশিত গণতান্ত্রিক উৎসব পরিণত হয় তর্ক-বিতর্ক আর অবিশ্বাসের আবহে।

ডাকসু: আইনি জটিলতা পেরিয়ে উচ্চ ভোটার অংশগ্রহণ
অন্যদিকে ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন। এটি ছিল ২০১৯ সালের পর দ্বিতীয় নির্বাচন। ভোটের আগে উচ্চ আদালত নির্বাচন স্থগিত করে দিয়েছিল। পরে আপিল বিভাগ সেই আদেশ বাতিল করলে নির্ধারিত সময়ে ভোট অনুষ্ঠিত হয়।
প্রায় চল্লিশ হাজার শিক্ষার্থী ভোটার তালিকায় ছিলেন। মোট ৪৭১ জন প্রার্থী ২৮টি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। সকাল আটটা থেকে বিকেল তিনটা পর্যন্ত ছয়টি ভোটকেন্দ্রে ভোট গ্রহণ হয়। এবার ভোটকেন্দ্রগুলো হল থেকে বাইরে নেওয়া হয়েছিল, যাতে হলভিত্তিক প্রভাব কমানো যায়।
ফলাফলে দেখা যায়, ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত “ঐক্যবদ্ধ ছাত্রজোট” বড় ধরনের জয় পেয়েছে। ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে শাদিক কায়েম বিজয়ী হন। জেচডি সমর্থিত প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান দ্বিতীয় স্থানে থাকেন। ভোটদানের হার ছিল প্রায় বাহাত্তর শতাংশেরও বেশি।
তুলনামূলক চিত্র: কে কোথায় দাঁড়াল
- জাকসুতে জেচডি সরাসরি প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে এসেছে, নির্বাচন বর্জন করেছে।
- ডাকসুতে জেচডি অংশ নিয়েছে, প্রার্থী দিয়েছে, এমনকি গুরুত্বপূর্ণ পদে দ্বিতীয় হয়েছে।
- দুই নির্বাচনেই ইসলামী ছাত্রশিবির-সমর্থিত প্রার্থীরা শক্ত অবস্থান নিয়েছে এবং শিক্ষার্থীদের একাংশ তাদের ভোট দিয়েছে।
- জাকসুতে বর্জন নির্বাচনী বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে, আর ডাকসুতে ফলাফল মেনে নিতে না পারলেও প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ ঘটেছে।

ভবিষ্যৎ ছাত্ররাজনীতি: কোন পথে যাবে?
১. আস্থা সংকট: শিক্ষার্থীরা চায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, কিন্তু বারবার অভিযোগ আর বর্জনের কারণে তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর আস্থা হারাচ্ছে।
২. শিবিরের উত্থান: দুটি নির্বাচনে তাদের সাফল্য দেখিয়ে দিল যে তারা সংগঠিতভাবে কাজ করছে। এটি ছাত্ররাজনীতির ভারসাম্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
৩. জেচডির দুরবস্থা: এক জায়গায় বর্জন, অন্য জায়গায় পরাজয়—দুটোই প্রমাণ করে জেচডি এখনো শক্ত অবস্থান গড়তে পারছে না।
৪. শিক্ষার্থীর প্রত্যাশা: ভোটদানের হার তুলনামূলক ভালো হলেও অভিযোগ ও উত্তেজনা শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করছে। তারা মনে করে নির্বাচন যেন কেবল আনুষ্ঠানিকতা, বাস্তব প্রতিনিধিত্বের নিশ্চয়তা নেই।
২০২৫ সালের জাকসু ও ডাকসু নির্বাচন আমাদের সামনে একটি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। ছাত্ররাজনীতিতে গণতন্ত্রের চর্চা শুরু হলেও আস্থার সংকট কাটেনি। দীর্ঘ বিরতির পর অনুষ্ঠিত জাকসু নির্বাচন আবারও বিতর্কে জড়ালো, আর ডাকসু নির্বাচন উচ্চ অংশগ্রহণ সত্ত্বেও প্রশ্নের বাইরে থাকল না।
ছাত্ররাজনীতিকে সত্যিকার অর্থে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বকারী করতে হলে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, স্বচ্ছ ভোট প্রক্রিয়া এবং সকল সংগঠনের আস্থার পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি। না হলে বর্জন আর বিতর্কের এই ধারা অব্যাহত থেকে যাবে।
সারাক্ষণ রিপোর্ট 



















