সিলেটে গত কয়েকদিন ধরে তীব্র বিদ্যুৎ সংকট দেখা দিয়েছে। শহর ও আশপাশের এলাকায় ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে উঠেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের গৃহস্থালি কাজেও এর প্রভাব পড়ছে।
প্রধান কারণ
এই সংকটের মূল কেন্দ্রে রয়েছে সিলেটের কুমারগাঁও বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ২২৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই পাওয়ার স্টেশনটি প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে বন্ধ রয়েছে। ফলে সিলেট অঞ্চলের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণ করা যাচ্ছে না।
এছাড়া ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে একাধিক সাবস্টেশন, ট্রান্সফরমার ও বিদ্যুৎ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক স্থানে দুর্ঘটনা এড়াতে সচেতনভাবে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ সরবরাহ আরও অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
ভোগান্তির বাস্তব চিত্র
সিলেট শহরের জিন্দাবাজার এলাকার কাপড় ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম বলেন, “দিনে চার-পাঁচ ঘণ্টা দোকানে বিদ্যুৎ থাকছে না। ফ্যান বন্ধ, আলো বন্ধ — ক্রেতারাও আসছে না। বিক্রি একেবারেই কমে গেছে।”
শাহজালাল উপশহরের গৃহিণী নুসরাত জাহান জানালেন, “বিদ্যুৎ না থাকলে রান্না, ফ্রিজ, সব অচল হয়ে যায়। বাচ্চাদের পড়াশোনা করাতেও সমস্যা হচ্ছে। রাতে গরমে ছোটরা ঘুমাতে পারছে না।”
মেডিকেল রোডের বাসিন্দা কলেজছাত্র তানভীর আহমেদ বলেন, “পরীক্ষার আগে বিদ্যুৎ চলে গেলে পড়াশোনাই করা যায় না। মোমবাতি বা চার্জ লাইট দিয়ে যতটুকু সম্ভব করি, কিন্তু মনোযোগ থাকে না।”
এই ভোগান্তি থেকে বোঝা যায়, সংকট কেবল বিদ্যুৎ ব্যবস্থার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি মানুষের জীবনযাত্রাকে সরাসরি বিপর্যস্ত করছে।
হাসপাতাল ও জরুরি সেবার ভোগান্তি
বিদ্যুৎ সংকটে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে হাসপাতাল ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবা খাত।
সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের এক কর্মকর্তা জানান, “লোডশেডিং হলে জেনারেটর চালাতে হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময় চালানো সম্ভব হয় না, কারণ জ্বালানি খরচ অনেক বেশি। আইসিইউ, অপারেশন থিয়েটার এবং ডায়ালাইসিস ইউনিটে বিদ্যুৎ না থাকলে রোগীদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি হয়।”
শহরের এক বেসরকারি ক্লিনিকের নার্স বলেন, “হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেলে অক্সিজেন সরবরাহ থেকে শুরু করে অন্যান্য জরুরি মেশিন চালু রাখতে হিমশিম খেতে হয়। এতে রোগী ও স্বজনরা আতঙ্কিত হয়ে ওঠেন।”
অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। রাতের বেলা বিদ্যুৎ না থাকায় অনেক এলাকায় সড়ক বাতিগুলো নিভে থাকে, এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ছে এবং রোগী পরিবহন বিলম্বিত হচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতি
সাধারণত সিলেটে দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা থাকে ১৪০ থেকে ১৬০ মেগাওয়াট। কিন্তু কুমারগাঁও কেন্দ্র বন্ধ থাকায় সরবরাহ অনেক সময় ৪০ থেকে ৬০ মেগাওয়াট পর্যন্ত কমে যাচ্ছে। ফলে প্রায় প্রতিদিনই কয়েক ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে। বাজার, হাসপাতাল ও আবাসিক এলাকায় মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
সমাধানের চেষ্টা
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের বরাতে জানা গেছে, কুমারগাঁও পাওয়ার স্টেশন পুনরায় সচল করার জন্য ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে বিশেষজ্ঞ দল এসেছে। তারা ত্রুটি চিহ্নিত করে মেরামতের কাজ শুরু করেছে। যদি সব কিছু পরিকল্পনা অনুযায়ী এগোয়, তবে এই সপ্তাহের মধ্যেই কেন্দ্রটি চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
কেন্দ্র সচল হলে সিলেট অঞ্চলের বিদ্যুৎ ঘাটতি অনেকটা কমে যাবে এবং সরবরাহ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে বলে আশা করা হচ্ছে।
জনগণের প্রত্যাশা
অতীত অভিজ্ঞতা অনুযায়ী মেরামতের কাজে সময় কিছুটা বেশি লাগতে পারে। তবে সরকার ও বিদ্যুৎ বিভাগের পক্ষ থেকে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। সিলেটের মানুষ এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে কবে আবার অবিরাম বিদ্যুৎ সুবিধা ফিরে আসবে।