বাংলাদেশের নগরায়ণ দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে। গ্রাম থেকে কাজের খোঁজে প্রতিনিয়ত মানুষ শহরে আসছে। কিন্তু এই নগর জীবনের সব আলো তাদের নাগালের মধ্যে নেই। ছয় মাস ধরে যারা শহরের ফুটপাত, বস্তি আর নিম্নআয়ের ভাড়া বাড়িতে বসবাস করছে—তাদের জীবন যেন টিকে থাকার এক নিরন্তর সংগ্রাম। অর্থনৈতিক অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি, ভাড়া বৃদ্ধি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় প্রবেশাধিকারের অভাব তাদের প্রতিদিনের বাস্তবতা।
খাদ্যের সংকট ও ক্ষুধার যন্ত্রণা
নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি নগর দরিদ্রদের জীবনে ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। চাল, ডাল, তেল, সবজি, মাংস—সবকিছুর দাম বেড়েছে। তিনবেলা খাবার নিশ্চিত করা এখন অনেকের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে উঠেছে।
রিকশাচালক রফিকুল ইসলাম (৪৫) বললেন, “আগে দিনে দুইবার মাছ বা ডাল খাওয়া যেত। এখন সন্তানদের জন্য ভাতের সাথে শুধু লবণ-মরিচ দিয়েই খেতে হয় অনেক সময়।”
খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা শুধু ক্ষুধাই নয়, অপুষ্টির সমস্যাও তৈরি করছে। শিশু ও বৃদ্ধদের মধ্যে অপুষ্টিজনিত রোগ বাড়ছে।
বাড়িভাড়া ও বাসস্থানের বোঝা
শহরে বসবাসরত নিম্ন আয়ের মানুষের সবচেয়ে বড় খরচ হলো বাড়িভাড়া। গত ছয় মাসে ভাড়া ২০-৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে একই ঘরে দুই-তিনটি পরিবার একসাথে বসবাস করছে।
মিরপুর বস্তির হাজেরা বেগম বলেন, “ভাড়া আর বিদ্যুতের বিল মেটাতে গিয়ে খাবার কেনার টাকাই থাকে না। বাড়িওয়ালা কমানোর কথা শুনতেই চায় না।”
বস্তির অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, স্যানিটেশন সংকট ও নিরাপত্তাহীনতা নগর দরিদ্রদের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তুলেছে।
আয় কমেছে, কাজ অনিশ্চিত
দৈনিক মজুরির শ্রমিক, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, গৃহকর্মী—এসব পেশায় কাজ পাওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সপ্তাহে তিন-চার দিন কাজ মেলে, বাকি সময় বসে থাকতে হয়।
একদিনমজুর করিম মিয়া জানান, “সপ্তাহে তিন-চার দিন কাজ পাই, বাকি দিন খালি বসে থাকতে হয়। ধার না করলে সংসার চলে না।”
এ অবস্থায় নগর দরিদ্রদের মধ্যে ঋণের বোঝা বাড়ছে। অনেকেই এনজিও থেকে ঋণ নিচ্ছে, আবার সুদের চাপে নতুন করে বিপদে পড়ছে।
শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে শিশু
অর্থনৈতিক সংকটে অনেক পরিবার সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ করে দিচ্ছে। স্কুলের ফি, বই-খাতা, পোশাক কেনার খরচ বহন করতে পারছে না। ফলে শিশুরা বাধ্য হয়ে ছোটখাটো কাজ করছে।
গুলশানের বস্তির মমতাজ বেগম বলেন, “মেয়েটাকে স্কুল থেকে তুলে নিতে হয়েছে। এখন সে বাসায় গৃহকর্মে সাহায্য করছে।”
শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া শিশুদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদে এটি সমাজের জন্য বড় সংকট তৈরি করবে।
স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চনা
নগর দরিদ্ররা সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত হচ্ছে স্বাস্থ্যসেবায়। সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভিড়, প্রাইভেট হাসপাতালে খরচ বহন অসম্ভব।
রিকশাচালক সেলিম উদ্দিন বলেন, “চোখে সমস্যা হচ্ছে, ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলাম, পরীক্ষা আর ওষুধ কিনতে এক হাজার টাকা চাইলো। টাকা জোগাড় করতে না পেরে ফিরে এসেছি।”
এভাবে অনেক রোগী চিকিৎসা ছাড়াই কষ্ট পাচ্ছে। দীর্ঘস্থায়ী রোগ যেমন ডায়াবেটিস, হাঁপানি, উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসা ছাড়া থেকে যাচ্ছে।
নারীদের দ্বিগুণ বোঝা
নারীরা নগর দরিদ্র জীবনে দ্বিগুণ চাপের মুখে। একদিকে আয় কমেছে, অন্যদিকে সংসারের খরচ সামলাতে হচ্ছে। গৃহকর্মী হিসেবে যারা কাজ করেন, তাদের অনেক সময় পূর্ণ বেতন দেওয়া হয় না।
হাজেরা বেগম বলেন, “গৃহকর্মীর কাজ করি। অনেক সময় পুরো বেতন দেয় না, আবার ছুটি নিলে অর্ধেক কেটে রাখে।”
নারীদের এই পরিস্থিতি পারিবারিক চাপ ও মানসিক কষ্টকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
এনজিও ও সামাজিক সংগঠনের ভূমিকা
এনজিওগুলো ক্ষুদ্র ঋণ, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা কার্যক্রম চালু রেখেছে। তবে তা নগর দরিদ্রদের সামগ্রিক সংকট মোকাবেলায় যথেষ্ট নয়। অনেকেই অভিযোগ করেন, ঋণের সুদের চাপ নতুন সমস্যা তৈরি করছে।
এক সমাজকর্মী জানান, “আমরা সীমিত সামর্থ্যে স্বাস্থ্য ক্যাম্প চালু রেখেছি। কিন্তু এত বিপুল সংখ্যক দরিদ্র মানুষের জন্য এটি যথেষ্ট নয়।”
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
প্রাক্তন ব্যাংকার ও অর্থনীতিবিদ ড. জামাল মনে করেন, “নগর দরিদ্রদের সংকট মূলত কাঠামোগত সমস্যা। আয় ও ব্যয়ের ভারসাম্য নেই। খাদ্য, বাসস্থান ও স্বাস্থ্যসেবায় সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া সমাধান সম্ভব নয়।”
সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক নাসিমা আক্তার বলেন, “দরিদ্র শিশুরা শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ছে, যা ভবিষ্যতে নতুন প্রজন্মকে আরও দারিদ্র্যের মধ্যে ফেলবে।”
গত ছয় মাসে নগর দরিদ্ররা টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত থেকেও প্রতিদিন হেরে যাচ্ছে। খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য—সবক্ষেত্রেই তারা পিছিয়ে। সরকারি ও বেসরকারি কিছু উদ্যোগ থাকলেও তা অপ্রতুল।
নগর দরিদ্রদের জীবনমান উন্নয়নে প্রয়োজন আরও বিস্তৃত কর্মসূচি। স্বল্পমূল্যের বাসস্থান, সুলভ চিকিৎসা, শিশুদের শিক্ষা নিশ্চিতকরণ, নারীদের নিরাপদ কর্মসংস্থান এবং কর্মহীনদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা জাল গড়ে তুলতে হবে।