১০:৩০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর ২০২৫
আলিবাবা প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা’এর অ্যান্ট গ্রুপ সফর ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উদ্যোগ জোরদার এক দিনে সংসদ ও গণভোটের কর্মপরিকল্পনা চায় দলগুলো পুরান ঢাকার অতীত দিনের কথা ( কিস্তি-১২৯) বিশ্বের অর্থনীতি ও স্থিতিশীলতা ধ্বংসে এগিয়ে চলেছে হোয়াইট কলার টেরোরিজম স্যাম্পলের সিম্ফনি: ড্যানিয়েল লোপাটিনের পরীক্ষামূলক সাউন্ডস্কেপের নতুন বিস্তার এআই ভিডিও কমাতে ‘টোন ডাউন’ অপশন আনছে টিকটক রেকর্ড-নতুন ফল: চীনের জুনো ‘ঘোস্ট পার্টিকল’ ডিটেক্টরের অভাবনীয় সাফল্য ডেভনে আবার ফিরতে পারে বন্য বিড়াল: দুই বছরের গবেষণায় নতুন সম্ভাবনা প্রাচীন ভারতে গণিতচর্চা (পর্ব-৩২৭) নন-প্রফিট কাঠামোতে যাচ্ছে মাষ্টডন, সিইও পদ ছাড়ছেন প্রতিষ্ঠাতা ইউজেন রখকো”

ধানসিঁড়ি নদী: এখন কি আর কাঁদে সোনালী ডানার চিল

ঝালকাঠি জেলার বুক চিরে বয়ে চলা ধানসিঁড়ি নদী কেবল একটি জলধারা নয়; এটি এ অঞ্চলের মানুষ ও সংস্কৃতির অঙ্গীভূত অংশ। নদীর স্রোতধারার সঙ্গে মিলেমিশে গড়ে উঠেছে স্থানীয় মানুষের জীবিকা, অর্থনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ও সাহিত্য। কবি জীবনানন্দ দাশের কলমে অমর হয়ে যাওয়া এই নদী আজ হারাতে বসেছে তার ঐতিহ্য, সৌন্দর্য আর নাব্যতা। তবুও ধানসিঁড়ি ঝালকাঠির মানুষের কাছে রয়ে গেছে প্রাণের প্রতীক হিসেবে।

ভৌগোলিক অবস্থান ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

ধানসিঁড়ি নদীর প্রবাহ শুরু হয় বরিশাল অঞ্চলের ভেতরে। ঝালকাঠি সদর ও আশপাশের কয়েকটি উপজেলায় নদীটির বিস্তৃতি রয়েছে। একসময় এই নদী ছিল বাণিজ্যের মূল রুট। কাঠ, ধান, পাট ও অন্যান্য কৃষিজ পণ্য নৌকাযোগে ধানসিঁড়ি দিয়েই আনা-নেওয়া হতো। বয়স্করা বলেন, ব্রিটিশ আমলেও এই নদীর কোল ঘেঁষে ছোট ছোট ঘাট ও হাট গড়ে উঠেছিল।

স্থানীয় ইতিহাসবিদ আলহাজ ফারুক হোসেন জানান, “ধানসিঁড়ি নদী শুধু ঝালকাঠির অর্থনীতির অংশ ছিল না, বরং দক্ষিণ বাংলার যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৫০ সালের আগ পর্যন্ত এ নদী দিয়েই বড় বড় নৌযান চলাচল করত।”

অর্থনীতি ও জনজীবন

ধানসিঁড়ি নদী কৃষিজীবী মানুষের প্রধান সহায়ক শক্তি ছিল। গ্রামীণ বাজারে উৎপাদিত ধান, শাকসবজি, গরু-ছাগলসহ নানান পণ্য সহজেই নৌকায় পরিবহন করা যেত। জেলেরা মাছ ধরতেন, আর নারীরা নদীর জলে কাপড় কাচতেন, চাল ধোতেন।

স্থানীয় জেলে নুরুল ইসলাম বলেন, “আমরা ছোটবেলায় এই নদী থেকেই প্রচুর ইলিশ, পুঁটি, কাতলা ও শোল ধরতাম। এখন সেই মাছের দেখা পাওয়া দুষ্কর। নদীর পানি কমে গেছে, দূষণ বেড়েছে।”

একইভাবে কৃষক মো. হারুন অভিযোগ করে বলেন, “ধানসিঁড়ি যদি ভরা থাকত, তাহলে আমাদের জমির সেচে কোনো সমস্যা হতো না। এখন অনেক সময় টিউবওয়েলের পানির ওপর নির্ভর করতে হয়।”

জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ

অতীতে ধানসিঁড়ি নদীর দুই তীরজুড়ে ছিল সবুজের সমারোহ। বাঁশঝাড়, তালগাছ, আমগাছ, নারিকেল গাছ আর পাখির কলতানে মুখর থাকত নদীর পাড়। শীতের মৌসুমে আসত অতিথি পাখি। কিন্তু এখন সেই পরিবেশ অনেকটাই হারিয়ে গেছে।

স্থানীয় পরিবেশকর্মী সালমা বেগম বলেন, “এই নদীতে একসময় ডাহুক, বক, পানকৌড়ি, শামুকখোল ভেসে বেড়াত। নদীর তলদেশে ছিল শাপলা-শালুক। দখল আর দূষণে সব হারিয়ে যাচ্ছে।”

সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ধানসিঁড়ি

বাংলা সাহিত্যে ধানসিঁড়ি নদীর নাম এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর অমর কবিতা ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়ির তীরে’ লিখে এই নদীকে সাহিত্যকীর্তিতে অমর করে তুলেছেন। কবির কলমে ধানসিঁড়ি হয়ে উঠেছে শৈশবের স্মৃতির নদী, যা মৃত্যুর পরেও তাকে টেনে নিয়ে যাবে।

স্থানীয় শিক্ষক রফিকুল আলম বলেন, “আমরা ধানসিঁড়িকে শুধু একটি নদী হিসেবে দেখি না; এটি আমাদের সাহিত্যের অংশ, কবিতার অংশ। জীবনানন্দ দাশ না থাকলে হয়তো আজ এই নদী এত আলোচিত হতো না।”

সংকট: দখলদূষণ ও নাব্যতার হ্রাস

বর্তমানে ধানসিঁড়ি নদী নানা সংকটে জর্জরিত।

দখল: নদীর তীরে অগণিত স্থাপনা গড়ে উঠেছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা নদী ভরাট করে দোকানপাট ও বসতবাড়ি তৈরি করেছেন।

দূষণ: প্লাস্টিক, ড্রেনের ময়লা, শিল্পকারখানার বর্জ্যে নদী দূষিত হচ্ছে প্রতিদিন।

নাব্যতার হ্রাস: পলি জমে নদীর গভীরতা কমেছে। শুষ্ক মৌসুমে অনেক জায়গায় হাঁটু সমান পানি থাকে।

স্থানীয় ব্যবসায়ী আলী আকবর বলেন, “নদী যদি এভাবে ভরাট হয়ে যায়, তাহলে একদিন হয়তো মানচিত্র থেকেও হারিয়ে যাবে ধানসিঁড়ি।”

সরকার ও জনগণের উদ্যোগ

কয়েক বছর আগে নদী খননের ঘোষণা দেওয়া হলেও তা সীমিত আকারে হয়েছে। তবে দখলমুক্ত করার উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান হয়নি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে কাজের অগ্রগতি অত্যন্ত কম।

পরিবেশবাদীরা মনে করেন, নদী রক্ষার জন্য স্থানীয় জনগণকে আরও সংগঠিত হতে হবে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সচেতনতা তৈরি জরুরি।

ভবিষ্যতের করণীয়

  • নদী খনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা।
  • দখলমুক্ত করার জন্য কঠোর আইন প্রয়োগ।
  • নদীকে কেন্দ্র করে ইকোট্যুরিজম ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালু করা।
  • স্কুল-কলেজে ধানসিঁড়ির ইতিহাস পড়ানো,যাতে নতুন প্রজন্ম নদীর গুরুত্ব বুঝতে পারে।

ধানসিঁড়ি নদী ঝালকাঠির মানুষের কাছে কেবল একটি ভৌগোলিক সত্তা নয়; এটি ইতিহাস, সাহিত্য, অর্থনীতি ও পরিবেশের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক জীবন্ত প্রতীক। যদি সময়মতো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তবে ধানসিঁড়ি আবার তার পুরনো গৌরব ফিরে পেতে পারে। নইলে কবির অমর স্মৃতির নদী হয়তো হারিয়ে যাবে মানুষের অসচেতনতা ও লোভের কাছে।

জনপ্রিয় সংবাদ

আলিবাবা প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা’এর অ্যান্ট গ্রুপ সফর ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উদ্যোগ জোরদার

ধানসিঁড়ি নদী: এখন কি আর কাঁদে সোনালী ডানার চিল

০২:০১:২৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ঝালকাঠি জেলার বুক চিরে বয়ে চলা ধানসিঁড়ি নদী কেবল একটি জলধারা নয়; এটি এ অঞ্চলের মানুষ ও সংস্কৃতির অঙ্গীভূত অংশ। নদীর স্রোতধারার সঙ্গে মিলেমিশে গড়ে উঠেছে স্থানীয় মানুষের জীবিকা, অর্থনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ও সাহিত্য। কবি জীবনানন্দ দাশের কলমে অমর হয়ে যাওয়া এই নদী আজ হারাতে বসেছে তার ঐতিহ্য, সৌন্দর্য আর নাব্যতা। তবুও ধানসিঁড়ি ঝালকাঠির মানুষের কাছে রয়ে গেছে প্রাণের প্রতীক হিসেবে।

ভৌগোলিক অবস্থান ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

ধানসিঁড়ি নদীর প্রবাহ শুরু হয় বরিশাল অঞ্চলের ভেতরে। ঝালকাঠি সদর ও আশপাশের কয়েকটি উপজেলায় নদীটির বিস্তৃতি রয়েছে। একসময় এই নদী ছিল বাণিজ্যের মূল রুট। কাঠ, ধান, পাট ও অন্যান্য কৃষিজ পণ্য নৌকাযোগে ধানসিঁড়ি দিয়েই আনা-নেওয়া হতো। বয়স্করা বলেন, ব্রিটিশ আমলেও এই নদীর কোল ঘেঁষে ছোট ছোট ঘাট ও হাট গড়ে উঠেছিল।

স্থানীয় ইতিহাসবিদ আলহাজ ফারুক হোসেন জানান, “ধানসিঁড়ি নদী শুধু ঝালকাঠির অর্থনীতির অংশ ছিল না, বরং দক্ষিণ বাংলার যোগাযোগ ব্যবস্থায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ১৯৫০ সালের আগ পর্যন্ত এ নদী দিয়েই বড় বড় নৌযান চলাচল করত।”

অর্থনীতি ও জনজীবন

ধানসিঁড়ি নদী কৃষিজীবী মানুষের প্রধান সহায়ক শক্তি ছিল। গ্রামীণ বাজারে উৎপাদিত ধান, শাকসবজি, গরু-ছাগলসহ নানান পণ্য সহজেই নৌকায় পরিবহন করা যেত। জেলেরা মাছ ধরতেন, আর নারীরা নদীর জলে কাপড় কাচতেন, চাল ধোতেন।

স্থানীয় জেলে নুরুল ইসলাম বলেন, “আমরা ছোটবেলায় এই নদী থেকেই প্রচুর ইলিশ, পুঁটি, কাতলা ও শোল ধরতাম। এখন সেই মাছের দেখা পাওয়া দুষ্কর। নদীর পানি কমে গেছে, দূষণ বেড়েছে।”

একইভাবে কৃষক মো. হারুন অভিযোগ করে বলেন, “ধানসিঁড়ি যদি ভরা থাকত, তাহলে আমাদের জমির সেচে কোনো সমস্যা হতো না। এখন অনেক সময় টিউবওয়েলের পানির ওপর নির্ভর করতে হয়।”

জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ

অতীতে ধানসিঁড়ি নদীর দুই তীরজুড়ে ছিল সবুজের সমারোহ। বাঁশঝাড়, তালগাছ, আমগাছ, নারিকেল গাছ আর পাখির কলতানে মুখর থাকত নদীর পাড়। শীতের মৌসুমে আসত অতিথি পাখি। কিন্তু এখন সেই পরিবেশ অনেকটাই হারিয়ে গেছে।

স্থানীয় পরিবেশকর্মী সালমা বেগম বলেন, “এই নদীতে একসময় ডাহুক, বক, পানকৌড়ি, শামুকখোল ভেসে বেড়াত। নদীর তলদেশে ছিল শাপলা-শালুক। দখল আর দূষণে সব হারিয়ে যাচ্ছে।”

সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে ধানসিঁড়ি

বাংলা সাহিত্যে ধানসিঁড়ি নদীর নাম এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর অমর কবিতা ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়ির তীরে’ লিখে এই নদীকে সাহিত্যকীর্তিতে অমর করে তুলেছেন। কবির কলমে ধানসিঁড়ি হয়ে উঠেছে শৈশবের স্মৃতির নদী, যা মৃত্যুর পরেও তাকে টেনে নিয়ে যাবে।

স্থানীয় শিক্ষক রফিকুল আলম বলেন, “আমরা ধানসিঁড়িকে শুধু একটি নদী হিসেবে দেখি না; এটি আমাদের সাহিত্যের অংশ, কবিতার অংশ। জীবনানন্দ দাশ না থাকলে হয়তো আজ এই নদী এত আলোচিত হতো না।”

সংকট: দখলদূষণ ও নাব্যতার হ্রাস

বর্তমানে ধানসিঁড়ি নদী নানা সংকটে জর্জরিত।

দখল: নদীর তীরে অগণিত স্থাপনা গড়ে উঠেছে। স্থানীয় প্রভাবশালীরা নদী ভরাট করে দোকানপাট ও বসতবাড়ি তৈরি করেছেন।

দূষণ: প্লাস্টিক, ড্রেনের ময়লা, শিল্পকারখানার বর্জ্যে নদী দূষিত হচ্ছে প্রতিদিন।

নাব্যতার হ্রাস: পলি জমে নদীর গভীরতা কমেছে। শুষ্ক মৌসুমে অনেক জায়গায় হাঁটু সমান পানি থাকে।

স্থানীয় ব্যবসায়ী আলী আকবর বলেন, “নদী যদি এভাবে ভরাট হয়ে যায়, তাহলে একদিন হয়তো মানচিত্র থেকেও হারিয়ে যাবে ধানসিঁড়ি।”

সরকার ও জনগণের উদ্যোগ

কয়েক বছর আগে নদী খননের ঘোষণা দেওয়া হলেও তা সীমিত আকারে হয়েছে। তবে দখলমুক্ত করার উদ্যোগ এখনো দৃশ্যমান হয়নি। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে কাজের অগ্রগতি অত্যন্ত কম।

পরিবেশবাদীরা মনে করেন, নদী রক্ষার জন্য স্থানীয় জনগণকে আরও সংগঠিত হতে হবে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে সচেতনতা তৈরি জরুরি।

ভবিষ্যতের করণীয়

  • নদী খনন করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা।
  • দখলমুক্ত করার জন্য কঠোর আইন প্রয়োগ।
  • নদীকে কেন্দ্র করে ইকোট্যুরিজম ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চালু করা।
  • স্কুল-কলেজে ধানসিঁড়ির ইতিহাস পড়ানো,যাতে নতুন প্রজন্ম নদীর গুরুত্ব বুঝতে পারে।

ধানসিঁড়ি নদী ঝালকাঠির মানুষের কাছে কেবল একটি ভৌগোলিক সত্তা নয়; এটি ইতিহাস, সাহিত্য, অর্থনীতি ও পরিবেশের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এক জীবন্ত প্রতীক। যদি সময়মতো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তবে ধানসিঁড়ি আবার তার পুরনো গৌরব ফিরে পেতে পারে। নইলে কবির অমর স্মৃতির নদী হয়তো হারিয়ে যাবে মানুষের অসচেতনতা ও লোভের কাছে।