ইসলামাবাদের শিল্পী এহতিশাম জাদুন পুরোনো লোহা, গাড়ির যন্ত্রাংশ ও ভাঙাচোরা ধাতুকে রূপ দিচ্ছেন বিশাল ভাস্কর্যে। তার গ্যালারিতে ঢুকলেই চোখে পড়ে মরিচাধরা শিংওলা আইবেক্স, গিয়ারের পেটওলা টিরানোসরাস কিংবা ইস্পাতের কেবল দিয়ে তৈরি কেশরওলা সিংহ। ঝুঁকিপূর্ণ এই কাজ তাকে প্রতিদিন পোড়াচ্ছে, তবুও তিনি থামেননি।
নিজেকে খুঁজে পাওয়া
জাদুন জানান, জীবনের ৩৫ বছর পার করার পরও তিনি জানতেন না তার আসল আগ্রহ কী। মার্শাল আর্ট ও মাউন্টেন বাইকিং চেষ্টা করার পর বুঝতে পারেন হাতে-কলমে কিছু তৈরির মধ্যেই তার শক্তি প্রকাশ পায়। টেক্সটাইল ব্যবসা ও নির্মাণকাজের পর তিনি ধাতু নিয়ে কাজ শুরু করেন, কোনো আনুষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা ছাড়াই।
তিনি বলেন, “ওয়েল্ডিং খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, প্রতি দুই সপ্তাহে বড় কোনো আঘাত পাই। তবে প্রতিদিনই ছোটখাটো পোড়া লাগে। তবুও এতে আনন্দ আছে, নতুনত্ব আছে।”
শিক্ষা ও অনুপ্রেরণা
তার প্রথম শিক্ষক ছিলেন এক বধির ওয়েল্ডার। সেই নীরবতার মধ্যে কাজ শিখতে শিখতে জাদুন শুধু শিল্পকলা নয়, সহকর্মীদের প্রতি সম্মান আর তাদের উন্নতির দায়িত্বও বুঝতে পারেন। তিনি বলেন, “আমার ভাস্কর্য কেবল আমার কণ্ঠ নয়, আমার সঙ্গে যারা কাজ করেছেন তাদের কণ্ঠও।”
সৃজনশীল প্রক্রিয়া
জাদুনের শিল্পকর্ম শুরু হয় কল্পনায়। তিনি স্কেচ করেন না, সরাসরি কাজে লেগে পড়েন। প্রতিটি প্রকল্প শেষ করতে তার ২,০০০ থেকে ৩,০০০ ঘণ্টা লেগে যায়। যেমন তার এক ধাতব গাছের ভাস্কর্যের ব্যাস ২৫ ফুট, যাতে রয়েছে ৭–৮ হাজার পাতা আর ১০–১৫ হাজার ডাল। আবার টিরানোসরাস ভাস্কর্যে প্রতিটি ধাতব খণ্ডকে আঁশের মতো কেটে বসানো হয়েছে।
তিনি প্রতিদিন ১২–১৪ ঘণ্টা কাজ করেন, এক বছরেরও বেশি সময় ধরে একদিনও বিশ্রাম নেননি। প্রতিটি ভাস্কর্য একাধিকবার ভেঙে আবার নতুন করে তৈরি করেন। যেমন সিংহ ভাস্কর্য দুবার, ডাইনোসর চারবার বানাতে হয়েছে তার।
বৃহৎ ভাস্কর্য ও চ্যালেঞ্জ
তার কাজ বিশাল ও ভারী। ডাইনোসরের ভাস্কর্য ২২ ফুট লম্বা, ১২ ফুট উঁচু আর ওজন প্রায় দুই টন। গণ্ডারের ভাস্কর্য এত ভারী যে সেটি নড়াতে পাঁচজন মানুষের দরকার হয়। এই ভারেই তার কর্মশালার মেঝে পর্যন্ত ভেঙে গেছে।
প্রকৃতি ও চলচ্চিত্র থেকে অনুপ্রেরণা
অ্যাবোট্টাবাদের সন্তান জাদুন প্রকৃতি থেকে অনুপ্রেরণা পান। তিনি দেখেছেন কীভাবে নগরায়ণ তার শৈশবের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য কেড়ে নিয়েছে। তার কাজের মধ্যে আছে সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা। পাশাপাশি চলচ্চিত্র থেকেও তিনি ধারণা নেন; যেমন ‘জুরাসিক পার্ক’-এর টিরানোসরাস তাকে অনুপ্রাণিত করেছে।
তার মতে, পুরোনো ধাতুর সৌন্দর্য সময়ের সাথে বাড়ে। ভাঙারিতে পড়ে থাকা ধাতব অংশগুলোতেও তিনি সম্ভাবনা খুঁজে পান।
দেশপ্রেম ও শিল্পের লক্ষ্য
শিল্পকর্মের অর্থ দিয়ে তিনি স্থানীয়দের কর্মসংস্থান করছেন, তাদের দক্ষতা বাড়াচ্ছেন। তিনি বলেন, “মানুষকে বুঝতে হবে শিল্পই আশার প্রতীক হতে পারে।” তার স্বপ্ন, পাকিস্তানের বিমানবন্দরসহ পাবলিক স্থানে এই শিল্প প্রদর্শিত হোক। সবচেয়ে প্রিয় ভাস্কর্য তার তৈরি মারখোর — পাকিস্তানের জাতীয় প্রাণী।
ভবিষ্যতের স্বপ্ন
জাদুন চান হুনজার পাসু কোনসের সামনে ৭০ ফুট লম্বা আগুন উগরানো ড্রাগন স্থাপন করতে। তিনি বিশ্বাস করেন এটি হবে পাকিস্তানের সবচেয়ে চমকপ্রদ ভাস্কর্য।
তার কর্মশালা সবসময় খোলা থাকে, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদেরও তিনি স্বাগত জানান। ২২–২৫ সেপ্টেম্বর ইসলামাবাদের সেন্টোরাস মলে তার প্রদর্শনী হবে, পরে করাচি তেও পরিকল্পনা আছে। তবে তার মূল লক্ষ্য উন্নয়নহীন অঞ্চলে শিল্প স্থাপন, যাতে মানুষ শিল্প দেখতে আসার পাশাপাশি স্থানীয়দের সাহায্য করে।
বার্তা তরুণদের জন্য
সবশেষে জাদুন বলেন, জীবনের শিক্ষা হলো জীবন অনিশ্চিত। তিনি তরুণদের পরামর্শ দেন স্ক্রিন-এ সময় নষ্ট না করে বাস্তবে কিছু তৈরি করতে। তার মতে, একটি জীবন তখনই সার্থক, যখন তা ইতিবাচক প্রভাব ফেলে যায়।