৬। নবশাখ বা নবশায়ক-শূদ্রজাতি নয় শাখায় বিভক্ত বলিয়া এই জাতির নাম নবশাখ হয়। তিলি, মালি, তামুলি, গোপ, নাপিত, গোছালি, কামার, কুমার, পুঁটুলি এই নয় জাতি নবশাখ আখ্যায় পরিচিত।২২ ইহাদের ব্যবসায় অনুযায়ী জাতি নির্ণয় করা হইয়াছে। অতিপুরাকালে আর্যজাতিরা যাহাদের পরাজিত করিয়া বন্দি করেন, তাহারা আচারভ্রষ্ট শূদ্র আখ্যা প্রাপ্ত হইয়া ত্রৈবর্ণের কার্যে নিযুক্ত হয়। তখন সংসার যাত্রা নির্বাহ জন্য স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র ব্যবসায়ী জাতিরও প্রয়োজন হইল। সে সময় ত্রৈবর্ণের নিচে শূদ্র ভিন্ন অন্য জাতি ছিল না। সুতরাং শূদ্রগণের মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবসায়ী লোকের সৃষ্টি হইল। এই আচারভ্রষ্ট শূদ্রগণ মধ্যে যাহারা ত্রৈবর্ণের সেবায় বা সংস্রবে জ্ঞান লাভ করেন, তাহারা শূদ্র মধ্যে উৎকর্ষ লাভ করিয়া সম্মানিত হইতে লাগিলেন এবং যাহারা অজ্ঞানই রহিল বা নিকৃষ্ট কর্মে রত হইল, তাহারা নিকৃষ্ট শূদ্র শ্রেণিতে পরিগণিত হইল। এই অপেক্ষাকৃত জ্ঞানী শূদ্রগণ উল্লিখিত নয় শাখায় বিভক্ত হইয়া ব্যবসানুযায়ী নবশাখ বলিয়া পরিচিত হইল। ইহাই বেশি সম্ভব। কিন্তু “সম্বন্ধ নির্ণয়ের” গ্রন্থকার পণ্ডিত প্রবর লালমেম্মাহন বিদ্যানিধি মহাশয় নবশাখের অন্যরূপ ব্যাখ্যা করেন। “যৎকালে মহাবীর পরশুরাম পৃথিবীকে একবিংশতিবার নিঃক্ষত্রিয় করেন তৎকালে এই কয়েক জাতির সাহায্য লইয়া তিনি ক্ষত্রিয় বংশের ধবংস করিতে সমর্থ হন। ইহাদিগেরই সাহায্যে পরশুরামের প্রতিজ্ঞা সিদ্ধ হয় (অর্থাৎ ক্ষত্রিয়কুলের বিনাশ বিষয়ে ইহারা শায়ক (বান) স্বরূপ হয়)। ইহারা পূর্বে কায়স্থের তুল্য ছিল না। ঐ সময়াবধি কায়স্থের তুল্য হয়। পরশুরাম দ্বারা সমাজ মধ্যে এতাদৃশ মর্যাদা পাইয়াই ইহারা ক্ষত্রিয়দিগের বিরুদ্ধে উত্থান করিয়াছিল”। এই উদ্ধৃত অংশ পৌরাণিক কথা। ইহার সারাংশ গ্রহণ করিলে, ইহা প্রতীত হইবে নবশাখ শূদ্রজাতি এবং ক্ষত্রিয়ের নিচ বলিয়া তাহাদের বিরুদ্ধে উত্থান হয়। এস্থলে ইহাও বলা যাইতে পারে যে, যদি কায়স্থ ক্ষত্রিয় না হইয়া নবশাখের মত শূদ্রজাতি হইত, তাহা হইলে কায়স্থ ও ক্ষত্রিয়ের ধ্বংস জন্য পরশুরামকে সাহায্য করিত। আবার “শায়ক” শব্দের সহিত “নব” শব্দ সংযোজিত করিলে “নবশায়ক” হইল। তবে কি “নবশায়ক” শব্দে “নূতনবান” কি “নয়বান” বুঝাইবে? “নবশায়ক” শব্দে নূতন বান বা নয়বান বুঝাইতে পারে। শূদ্রেরা নূতনবান গ্রহণ করিয়া ক্ষত্রিয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বা শূদ্রের নয় শ্রেণি একত্রিত হইয়া যুদ্ধ করে এই হেতু ইহারা নবশায়ক বা নবশাক নাম ধারণ করিল। অতএব উদ্ধৃত অংশের উপর ভিত্তিস্থাপন করিয়া নকশাক না বলিয়া নবশায়ক বলিলেও কোন বিশেষ ক্ষতি দেখি না। আবার বিদ্যানিধি মহাশয় বলিয়াছেন নবশাকেরা “সজ্জুদ্র বলিয়া পরিগণিত”। আমরা বিদ্যানিধি মহাশয়ের পক্ষ সমর্থন করিতে পারিলাম না। ধরণীকোষ মতে সচ্ছদ্র কেবল ক্ষত্রিয়কেই বুঝায়। ইহা নিম্ন উদ্ধত শ্লোকে প্রমাণ হইবে।-
“সচ্ছদ্র, মসীশদেব কায়স্থশ্চ শ্রীবৎসজঃ।
অন্বষ্ঠো মাথুরীভট্টঃ সূর্যধ্বজশ্চ গৌড়কঃ।।”
ধরণী মতে কায়স্থ ক্ষত্রিয় এবং ক্ষত্রিয় সচ্ছদ্র। আবার স্কন্দপুরাণ মতে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, সচ্ছদ্র এবং ইহারা শালগ্রামশীলা স্পর্শ করিতে সক্ষম। এ বিষয়ে নিম্নবচনে প্রমাণ হইবে:-
“ব্রাহ্মণ ক্ষত্র বৈশ্যানাং সচ্ছদ্রানা মথাপিবা।
শালগ্রামেহধিকারোজি নচান্যেষাং কদাচন।।”
নবশাখ যে সচ্ছদ্র নহে তাহার সন্দেহ রহিল না। নবশাখ শূদ্রজাতীয়। কিন্তু ইহারা ভাল শূদ্র এবং ইহাদের স্পর্শীয় জল সকল জাতিই পান করিতে পারে। “নবশাখেরা কায়স্থ সদৃশ সদাচার সম্পন্ন। ইহাদিগের পুরোহিত ও কায়স্থদিগের পুরোহিত এক।” ২০ একথা কতদূর ঠিক তাহা আমরা বলিতে পারি না। পূর্ববঙ্গে যে সকল বঙ্গজ কায়স্থ বসতি করিতেছেন, তাহাদের এবং সেই দেশবাসী নাবশাখ বিধবা রমণীদের আচার ব্যবহার ও ক্রিয়াকলাপ দেখিলে “নবশাখেরা কায়স্থ সদৃশ সদাচার সম্পন্ন” বলা ভ্রমপদ হইবে। বঙ্গজ কায়স্থ সমাজে বিধবা রমণীদের আচার ব্যবহার ঠিক ব্রাহ্মণ বিধবা রমণীর ন্যায়। বঙ্গের কায়স্থ বিধবা রমণী ব্রহ্মচর্য-ব্রত-চারিণী। পক্ষান্তরে নবশাখ বিধবা রমণীগণেরা ব্রহ্মচর্য ব্রতচারিণী নহে। ইহাদের মধ্যে অনেকেই স্বেচ্ছাচারিণী। এই রূপে কায়স্থ ও নবশাখ পুরুষদের আচার ব্যবহারে অনেক প্রভেদ আছে। পূর্ববঙ্গে নবশাখেরা বঙ্গজ কায়স্থদের ব্রাহ্মণের ন্যায় সম্মান করিয়া থাকে। কিন্তু রাজসাহীতে এরূপ ভাব দেখা যায় না। এজেলায় নবশাখদের মধ্যে অনেক বিধবা রমণী ব্রহ্মচর্য-ব্রত-চারিণী নহে এবং পুরুষেরাও যথেষ্ট আচার ভ্রষ্ট। রাজসাহীর নবশাখেরা কায়স্থদের ব্রাহ্মণের ন্যায় সম্মান করে না। ইহার কারণ এই যে রাজসাহীতে বারেন্দ্র কায়স্থের সমাজ প্রধান, বঙ্গজ কায়স্থ দুই চারি ঘর মাত্র আছে। বারেন্দ্র কায়স্থের আচার ব্যবহার বঙ্গজ কায়স্থের সদৃশ নয় বলিয়াই নবশাখেরা রাজসাহীর কায়স্থদের বঙ্গজ কায়স্থদের ন্যায় সম্মান করে না। মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের কাল হইতে নবদ্বীপ এয়ং তন্নিকটবর্তী স্থানের নবশাখগণের আচার ব্যবহার অনেক সংশোধিত হইয়াছে বসিয়া সেই প্রদেশের নবশাখদের আচার ব্যবহার দক্ষিণ রাঢ়ীয় কায়স্থ সদৃশ দেখা যায়। আমরা স্বীকার করি নবশাখের শিক্ষা, সভ্যতা, ধন ও সম্মান বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাহাদের আচার ব্যবহারের অনেক পরিবর্তন হইতেছে। এমতাবস্থায়ও দেখিতে পাওয়া যায় যে অনেক স্থলে বঙ্গজ কায়স্থের ও নবশাখের পুরোহিত এক নহে। অনেক বঙ্গজ কায়স্থও নবশাখের পুরোহিত দ্বারা ক্রিয়া কলাপ নির্বাহ করান না। পক্ষান্তরে ইহাও দেখা যায় ব্রাহ্মণ ও কায়স্থের পুরোহিত এক। তাই বলিয়া কি কায়স্থ ব্রাহ্মণ সদৃশ হইতে পারে?