যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ কয়েকটি দেশ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি বলেছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত আসলে “হামাসের নৃশংস সন্ত্রাসবাদকে পুরস্কৃত করা।” যুক্তরাষ্ট্রও স্পষ্টভাবে বিরোধিতা করেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে—স্বীকৃতি মানে কী? এর বাস্তব প্রভাব কী হতে পারে?
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র—আছে আবার নেইও
ফিলিস্তিনকে অনেক দেশই রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের কূটনৈতিক মিশন আছে, খেলাধুলায় অংশ নেয়, এমনকি অলিম্পিকেও দল পাঠায়।
তবু ফিলিস্তিনের এখনো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানা নেই, রাজধানী নেই, সেনাবাহিনী নেই। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি দখলের কারণে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (১৯৯০-এর দশকের শান্তি চুক্তির পর গঠিত) পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নেই। গাজায় চলছে ভয়াবহ যুদ্ধ, যেখানে ইসরায়েলকেই দখলদার শক্তি হিসেবে দেখা হয়।
তাই রাষ্ট্র স্বীকৃতি অনেকটাই প্রতীকী। বাস্তবে তাৎক্ষণিক পরিবর্তন না আনলেও রাজনৈতিক ও নৈতিক বার্তা দেবে।
ব্রিটেনের ঐতিহাসিক ভূমিকা
জাতিসংঘে ভাষণে সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেছিলেন—“ব্রিটেনের ওপর বিশেষ দায় আছে দুই-রাষ্ট্র সমাধানকে সমর্থন করার।”
তিনি ১৯১৭ সালের বেলফোর ঘোষণার কথা স্মরণ করান। তাতে ইহুদিদের জন্য ফিলিস্তিনে জাতীয় আবাস গঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও বলা হয়েছিল, সেখানকার অ-ইহুদি জনগোষ্ঠীর নাগরিক ও ধর্মীয় অধিকারের ক্ষতি করা যাবে না। সমালোচকদের মতে, এতে ফিলিস্তিনিদের জাতীয় অধিকার উপেক্ষিত হয়েছিল।
১৯২২ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে থাকা এ অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরেই “অসমাপ্ত আন্তর্জাতিক বিষয়” হিসেবে বিবেচিত। ইসরায়েল গঠিত হলেও ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে।
দুই-রাষ্ট্র সমাধান
“দুই-রাষ্ট্র সমাধান” বলতে বোঝানো হয়—পশ্চিম তীর ও গাজায় একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধ-পূর্ব সীমারেখা অনুযায়ী, আর পূর্ব জেরুজালেম রাজধানী।
কিন্তু শান্তি আলোচনার উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে, আর পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের অবৈধ বসতি স্থাপন এই সমাধানকে কার্যত ফাঁপা স্লোগানে পরিণত করেছে।
কে কে ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিয়েছে?
জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্য দেশের প্রায় ৭৫ শতাংশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের মর্যাদা “স্থায়ী পর্যবেক্ষক রাষ্ট্র”—অংশগ্রহণ করতে পারে, তবে ভোটাধিকার নেই।
যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের পাশাপাশি কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, মাল্টা স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এতে করে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে চারজন থাকবে ফিলিস্তিনের পক্ষে।
চীন ও রাশিয়া ১৯৮৮ সালেই স্বীকৃতি দিয়েছিল। ফলে যুক্তরাষ্ট্র একমাত্র ব্যতিক্রম হয়ে থাকবে।
কেন এখন এই সিদ্ধান্ত?
ব্রিটিশ সরকার দীর্ঘদিন ধরে বলছিল, তারা “সঠিক সময়ে” স্বীকৃতি দেবে। কিন্তু গাজার দুর্ভিক্ষ, ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে জনরোষ এবং আন্তর্জাতিক জনমতের বড় পরিবর্তন পরিস্থিতিকে জটিল করেছে।
কানাডা শর্ত দিয়েছে—ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে সংস্কার করতে হবে, ২০২৬ সালে নির্বাচন করতে হবে এবং একটি নিরস্ত্রীকৃত রাষ্ট্র গঠন করতে হবে।
ব্রিটেন বলেছে—ইসরায়েল যদি গাজায় কষ্ট লাঘব, যুদ্ধবিরতি, পশ্চিম তীরে দখলদারি বন্ধ এবং দুই-রাষ্ট্র সমাধানে অঙ্গীকার না করে, তাহলে তারা স্বীকৃতি দেবে। সমালোচকদের মতে, স্বীকৃতিকে শর্তযুক্ত করা উচিত নয়। তবে কার্যত অগ্রগতি না থাকায় স্বীকৃতি প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে।
এভাবে একযোগে পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে দেশগুলো গাজা যুদ্ধের অবসান ও ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নিয়ে আন্তর্জাতিক আলোচনাকে জোরদার করতে চায়।
যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর বিরোধিতা
যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতির বিপক্ষে। সাম্প্রতিক সময়ে এই অবস্থান আরও কঠোর হয়েছে।
২০২৩ সালের হামাসের হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেন—স্বীকৃতি দেওয়া মানে “সন্ত্রাসবাদের পুরস্কার” দেওয়া। তাঁর মতে, এতে হামাস আরও উৎসাহিত হবে এবং ইসরায়েল পশ্চিম তীর দখল করে নেবে।
তিনি স্বীকৃতি-সমর্থকদের সতর্ক করে বলেন—এটি গাজায় যুদ্ধবিরতি আরও কঠিন করে তুলবে।
ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি অনেকাংশে প্রতীকী হলেও এর রাজনৈতিক ও নৈতিক গুরুত্ব অনেক। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিলিস্তিনের অবস্থান শক্তিশালী হবে। তবে মাটিতে পরিস্থিতি বদলাতে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের বাস্তব রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া উপায় নেই।