রবিবার রাতের আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টি ঢাকার রাস্তাকে নদীতে পরিণত করেছিল। সোমবার সকালে ঘর থেকে বের হওয়া মানুষজন যেন শহরের ভেতরেই অন্য এক জগতে প্রবেশ করলেন। প্রধান সড়ক, অলিগলি, বাজার ও বাসাবাড়ির সামনে জমে থাকা পানি ঢাকার চিরচেনা ভোগান্তির নতুন সংস্করণ হয়ে ফিরে এলো।
ভোরবেলার দৃশ্য
মিরপুর, উত্তরা, বিজয় সরণি, ধানমন্ডি, শান্তিনগর, মালিবাগ, কাকরাইল, রামপুরা ও পুরান ঢাকার গলিপথ—সবখানেই হাঁটু থেকে কোমর সমান পানি। হাতিরঝিলের নিচু অংশও প্লাবিত। ভোরবেলার ব্যস্ত শহরে গাড়ি আটকে পড়েছে, রিকশা থেমে গেছে, বাস যাত্রীদের নামিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে মাঝপথেই।
মানুষের কণ্ঠে দুর্ভোগ
রিকশাচালক আবদুল করিম (মিরপুর)
“রাতভর বৃষ্টি থামেনি। সকালে রাস্তায় বের হই, কিন্তু অনেক জায়গায় পানি এত বেশি যে রিকশা চালানো যায় না। যাত্রী তুললেও দুই মিনিট পরেই আটকে যাচ্ছি। ভাড়া পাই না, আবার রিকশাও নষ্ট হচ্ছে পানিতে।”
দোকানি রহিম উদ্দিন (নীলক্ষেত বইপট্টি)
“ভোরে দোকান খুলতেই দেখি পানি ঢুকে গেছে ভেতরে। কিছু বই ভিজে গেছে, প্যাকেট করা খাতা নষ্ট হয়ে গেছে। রাতেই যদি খবর পেতাম, হয়তো বাঁচানো যেত। এখন এই ক্ষতি কে পূরণ করবে?”
স্কুলগামী শিশু রাফি (শান্তিনগর)
“আম্মু বলল আজ স্কুলে যেতে হবে। কিন্তু রাস্তা ভরা পানি। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম, জুতো খুলে প্যান্ট ভিজিয়ে স্কুলে গেছি। ক্লাসে গিয়েও সব ভিজা থাকায় বসতে খারাপ লাগছিল।”
অফিসকর্মী সেলিনা আক্তার (ধানমন্ডি)
“বাস থেকে নেমে প্রায় আধা কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছে কোমর সমান পানির ভেতর দিয়ে। অফিসে পৌঁছে দেখি পুরো পোশাক ভিজে গেছে। জরুরি মিটিং থাকায় ঘরে ফেরারও উপায় ছিল না। এরকম পরিস্থিতি প্রতি বছরই আমাদের সহ্য করতে হয়।”
বৃষ্টির কারণ ও সম্ভাবনা
আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, রবিবার রাত ১২টা থেকে সোমবার সকাল সাড়ে ৭টা পর্যন্ত ঢাকায় ৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় রেকর্ড হয়েছে প্রায় ৪০ মিলিমিটার। মৌসুমি বায়ু সক্রিয় থাকায় বৃষ্টিপাত বেড়েছে, সঙ্গে উত্তর বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আগামী ২৪ ঘণ্টায় ঢাকা, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট অঞ্চলে আরও বৃষ্টি হতে পারে। কোথাও কোথাও মাঝারি থেকে ভারী বর্ষণ হতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
অর্থনৈতিক প্রভাব
পুরান ঢাকার বাজার, নীলক্ষেত, চকবাজার ও মালিবাগের দোকানপাটে পানি ঢুকে গেছে। কাপড়, বই, বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের দোকানগুলোতে বড় ক্ষতি হয়েছে। পাইকারি বাজারে মাছ, সবজি ও ফলমূল নষ্ট হয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, প্রতি মৌসুমেই একই ক্ষতির শিকার হচ্ছেন তারা।
স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা
রাস্তার পানিতে ময়লা-আবর্জনা, নর্দমার পানি মিশে যাওয়ায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। ডেঙ্গু, ডায়রিয়া ও চর্মরোগের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। পানির চাপে বিদ্যুতের তার ডুবে যাওয়ায় দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বেড়েছে।
নগর পরিকল্পনার চ্যালেঞ্জ
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা দুর্বল। খাল ভরাট, ড্রেন পরিষ্কার না করা এবং অপরিকল্পিত নগরায়ন সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলছে। দ্রুত খাল উদ্ধার, আধুনিক নিষ্কাশন ব্যবস্থা তৈরি এবং সিটি কর্পোরেশন ও ওয়াসার সমন্বয় ছাড়া জলাবদ্ধতা কমানো সম্ভব নয়।
সার্বিক চিত্র
রাতভর আকাশ ভাঙ্গা বৃষ্টির পর ভোরে যে দৃশ্য তৈরি হয়, তা ঢাকাবাসীর জন্য নতুন কিছু নয়। প্রতি বছরই এমন দুর্ভোগ সহ্য করতে হয়। কিন্তু এই দুর্ভোগ কমাতে দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ না নিলে ঢাকায় প্রতিটি বর্ষাই পরিণত হবে দুঃস্বপ্নে।